ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিবন্ধিত ব্যবসায়ী আট লাখ, ভ্যাট দেন মাত্র ৬০ হাজার

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

নিবন্ধিত ব্যবসায়ী আট লাখ, ভ্যাট দেন মাত্র ৬০ হাজার

রহিম শেখ ॥ গত ২৬ বছরে আশানুরূপ বাড়েনি ভ্যাটের (মূল্য সংযোজন কর) পরিধি। গত এক দশকের ভ্যাট দেয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘুরে ফিরে একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত আট লাখ ব্যবসায়ীর মধ্যে ভ্যাট দিচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সংখ্যার হিসাবে এই গরমিল দেখে যে কারোরই ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি নজরে আসবে। খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও বলছে, ভ্যাট ফাঁকি হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, ছোট-বড় অধিকাংশই প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। তবে ভ্যাট নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠান খুঁজতে নিয়মিত অভিযান চালানোর কথা বলছে এনবিআর। এদিকে ভ্যাট দেয়ার পরও হয়রানি করার অভিযোগ তুলছেন কোন কোন ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, খাতাপত্র পরীক্ষার নামে নতুন করে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে। জানা গেছে, দেশে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তন শুরু হয় ১৯৯১ সালে। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ভ্যাট দিবস পালন শুরু করে এনবিআর। আগে ১০ জুলাই ভ্যাট দিবস পালন করা হলেও গত বছর থেকে এটি ১০ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে। আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্যাট সপ্তাহ পালন করা হবে। এনবিআর বলছে, দেশের বিশাল সংখ্যক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ পদ্ধতির ভ্যাটের আওতায়। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সব মিলিয়ে বছরে ১০ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়। এর বাইরে ১১ ক্যাটাগরির প্রায় সাড়ে আট হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ইসিআর ব্যবহার উপযোগী বলে চিহ্নিত করে। এসব প্রতিষ্ঠান ৪ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট প্রদানকারী। এসব প্রতিষ্ঠান বছরে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা ভ্যাট দেয় বলে জানা গেছে। তবে বর্তমানে দেশের ভ্যাটের জন্য নিবন্ধনভুক্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা আট লাখ। অথচ ‘ভ্যাট’ দেন মাত্র ৬০ হাজার ব্যবসায়ী। এর মধ্যে দেশের বড় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছেই মামলায় আটকা ১৬ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট। বিশাল অঙ্কের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে ১০ বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন সেবাদান একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই ৯৩২ কোটি টাকা ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে ভ্যাট বিভাগ। পরিসংখ্যান বলছে, ঘুরে ফিরে একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিচ্ছেন। এনবিআর ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্বের মধ্যে ভ্যাট খাত থেকে আহরণ করেছে ৬৭ হাজার কোটি। চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এ খাতে ৯১ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, ভ্যাট আদায়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও ব্যবসায়ীদের সচেতন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা কমার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ভ্যাটের পরিধি আরও বাড়বে বলে তিনি জানান। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি মিষ্টি বিপণকারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ভ্যাট ফাঁকির চিত্র তুলে ধরে ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাভুক্ত ভ্যাট অফিস। এতে দেখা যায়, একটি মিষ্টি প্রতিষ্ঠানের ৬টি বিক্রয়কেন্দ্রের বিক্রয় থেকে সম্মিলিতভাবে গত এক বছরে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) প্রদান করেছে ৫ লাখ টাকা। বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর খাতাপত্র জব্দ করে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে তাদের বিক্রির পরিমাণ ২ কোটি টাকা। মিষ্টির দোকানে বর্তমানে ভ্যাট ১৫ শতাংশ। সেই হিসেবে আদায়যোগ্য ভ্যাট ৩০ লাখ টাকা। অভিযান পরিচালনাকারী ভ্যাট অফিস ধারণা করছে, জব্দকৃত খাতাপত্র অনুযায়ী যে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ফাঁকি তার চাইতে অনেক বেশি। রাজধানীসহ দেশব্যাপী হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এভাবে স্বল্প পরিমাণে ভ্যাট প্রদানের আড়ালে বিশাল অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের খাতাপত্র জব্দ করে বড় অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে। স্বল্প পরিমাণে ভ্যাট প্রদানকারী এসব প্রতিষ্ঠানের কোন কোনটির কাছ থেকে কোটি টাকার ভ্যাটও আদায় হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ তারা ভ্যাট প্রদান করতো এক থেকে দুই লাখ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে প্যাকেজ পদ্ধতির সুবিধা নিয়ে মাত্র দুই হাজার আটশ’ টাকা। ভ্যাট আদায়কারী কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশে এ ধরনের অপেক্ষাকৃত কম ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সঠিকভাবে আদায় করা সম্ভব হলে বাড়তি ভ্যাট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ঢাকা দক্ষিণের ভ্যাট কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান কেবল প্যাকেজ পদ্ধতিতে অল্প পরিমাণ ভ্যাট দেয়। আবার কেউ কেউ চার শতাংশ কিংবা ১৫ শতাংশ হিসাবেও ভ্যাট দেয়। কিন্তু খাতাপত্র পরীক্ষার পর দেখা যায়, যে পরিমাণ ভ্যাট দেয় ফাঁকি তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু মোতালেবের অভিযোগ, খাতাপত্র পরীক্ষার নামে নতুন করে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে। তবে তালিকাভুক্ত সাড়ে আট হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা বিক্রয় সংক্রান্ত লেনদেন ইসিআর (ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার) বা পিওএস (পয়েন্ট অব সেল্স) সফটওয়্যারের মাধ্যমে হিসাব রাখা বাধ্যতামূলক করে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুড, মিষ্টির দোকান, ফার্নিচার, বিউটি পার্লার, কমিউনিটি সেন্টার, ডিপার্টমেন্টাল ও জেনারেল স্টোর, জুয়েলারি, মাঝারি ও বড় আকারের পাইকারি ও খুচরা দোকান এবং মেট্রোপলিটন এলাকার শপিংমলে অবস্থিত সব ধরনের দোকান ইসিআর বা পিওএস ব্যবহারের তালিকায় রয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এদের অনেকেই ইসিআর মেশিন ব্যবহার করে না কিংবা করলেও সব লেনদেন ইসিআরের মাধ্যমে করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার নতুন ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়ায় এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি বন্ধে বিশেষ জোর দেয়ার কৌশল নিচ্ছে বলে জানা গেছে। ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে ১০ বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে একটি মোবাইল ফোন সেবাদান কোম্পানি বিরুদ্ধেই ৯৩২ কোটি টাকা ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে ভ্যাট বিভাগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিট বা এলটিইউ-ভ্যাট বিভাগের সাম্প্রতিক গোয়েন্দা কার্যক্রম ও বিশেষায়িত নিরীক্ষায় এসব ফাঁকি বের হয়েছে। প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কাছেই ফাঁকির অর্থ পরিশোধের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধও জানানো হয়েছে।
×