ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিবন্ধী শিশু এবং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রতিবন্ধী শিশু এবং বাংলাদেশ

প্রতিটি মানুষ কিছু আশা, কিছু স্বপ্ন, কিছু পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সকল প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে জীবনের সব অধ্যায় সুন্দরভাবে পাড়ি দিতে সক্ষম হলেও কেউ প্রস্তুত থাকেন না প্রতিব›দ্ধী সন্তানের পিতা-মাতা হতে। এমন সন্তান পিতা-মাতার কাছে অনাকাক্সিক্ষত হলেও সে তাদের কাছে অন্য সন্তানের তুলনায় কোনভাবেই কম গুরুত্বের বা কম আদর-ভালবাসার নয়; বরং তারা দৈব্য সন্তান কিংবা বিধাতা প্রদত্ত বিশেষ সন্তান হিসেবেই বিবেচিত হয়। আর তাই তাঁরা সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকেন বিশেষ সন্তানটির বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে। সন্তানের উন্নতি এবং স্বাভাবিকতার জন্য যেমন নিয়মিত ছোটাছুটি করতে হয়, তেমনি প্রাপ্তি-প্রত্যাশার যোগ-বিয়োগে ভীষণভাবে হতাশও হতে হয়! এমন সন্তানের একজন গর্বিত পিতা হিসেবে আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যাদেরকে চিহ্নিত করা হয় বিশেষ জনগোষ্ঠী হিসেবে যা চরম বৈষম্যের বহির্প্রকাশ। প্রথমত : ‘প্রতিব›দ্ধী’ শব্দটি নিয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের পিতা-মাতা এবং নিকট আত্মীয়দের মাঝে প্রচ- আপত্তি রয়েছে। বাস্তবতার আলোকে আমরা সবাই জানি শারীরিক, মানসিক কিংবা ¯স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তিই হলো প্রতিবন্ধী। শব্দটি আভিধানিক অর্থে যথার্থ হলেও আমাদের সমাজে মাঝে মধ্যে শব্দটির নেতিবাচক প্রয়োগ বা ব্যবহার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। ফলে প্রতিবন্ধী শব্দটি খুব কম সংখ্যক পিতা-মাতাই গ্রহণ করতে পারেন। প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষকেও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। কেউ তা জয় করতে পারে; কেউ তা পারে না। তাহলে শুধু শারীরিক, মানসিক কিংবা ¯স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তিই প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত বা পরিচিত হবে কেন? তারা পৃথিবীর বৈচিত্র্যের অংশ। এই বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীর অনেক অবদান আছে বিশ্বের বিস্ময়কর কৃতিত্বে। দ্বিতীয়ত: ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হলো শিক্ষা যা মানব জীবনকে আলোকিত করার একমাত্র উপাদান। এই চেতনাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেই মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের দেশে সবার জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল স্তরের মানুষের জন্য আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিকসহ বিভিন্ন প্রদ্ধতির শিক্ষা চালু রয়েছে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসচ্ছল পরিবারের শিশু এবং কন্যা সন্তানেরাও যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয় বিধায় সে লক্ষ্যে তাদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থাসহ উপবৃত্তি প্রকল্পও চালু রয়েছে। আমাদের দেশে যা সত্যিই অনন্য দৃষ্টান্ত এবং প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু একই সঙ্গে একটি প্রশ্নও থেকে যায় যে, আমাদের দেশে যে এক বিশাল জনগোষ্ঠী শারীরিক, মানসিক কিংবা ¯স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত তাদের সকলের জন্য এই মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে কিনা? অথবা একই উদ্দেশ্যে বিশেষ কোন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে কিনা? তৃতীয়ত : প্রতিবন্ধকতার ধরন এবং মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন রকম এবং মেয়াদের চিকিৎসার ওপর আজীবন নির্ভর করতে হয় এসব শিশু ও ব্যক্তিদের। শারীরিকভাবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কিছুটা সহজতর হলেও ¯স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা বেশ জটিল। অটিজম, এ.ডি.এইচ.ডি, ডাউন্স সিনড্রম, সেরিব্রাল পালসিসহ ¯স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত সকল শিশু এবং ব্যক্তিদের চিকিৎসা এবং বিভিন্ন থেরাপির ওপর নির্ভর করতে হয় আজীবন। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতার ধরন নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং চিকিৎসালয় এখনও অনেকের নাগালের বাইরে। দেশে হাতেগোনা কয়েকটি সরকারী হাসপাতালে ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’ নামক বিশেষ সেল থাকলেও অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোতে তাদের জন্য এমন কোন সেবা-ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শিশুরাই বঞ্চিত হচ্ছে এই বিশেষ চিকিৎসা সেবা থেকে। একইভাবে সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার ব্যয়ভার বহন করা সকল পিতা-মাতার জন্য সহজ এবং সম্ভব হয়ে উঠে না। সুতরাং একমাত্র সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা ব্যক্তির চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। চতুর্থত : বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সন্তানদের প্রত্যেক পিতা-মাতার একমাত্র এবং সব চাইতে বড় উদ্বিগ্নতা হলো তাঁদের সন্তানের উন্নত নিরাপদ ভবিষ্যতের বিষয়ে। বিশেষ করে পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে তাঁদের সন্তানদের কি হবে? সবাই ভুলে যায়, কেবল শরীর কিংবা প্রকাশের ভঙ্গি নয়, অন্য সবার মতো সুন্দর একটি মন আছে তাদেরও; আছে মায়া, মমতা, দুঃখ, কষ্ট ভালবাসার অনুভূতি। শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে ভিন্নতা থাকলেও তারা অক্ষম নয়, বরং ভিন্নভাবে সক্ষম। সুতরাং এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝা না ভেবে তাদেরকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আর এই দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমাজেরও। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, অনুপ্রেরণা এবং নির্দেশনা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অবশ্য অটিজমসহ স্নায়ুবিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত বিশেষ শিশু এবং ব্যক্তিদের উন্নয়নে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কর্মাকা-ের পাশাপাশি কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন যা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আমাদের সন্তানদের জন্য অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় আমরা যতটা উৎসাহিত ঠিক ততটাই সাহসীও হয়েছি। আমরা মনে করি, সকলের জন্য সমান সুযোগ এবং অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিশেষ কোন কাজের উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন সর্বাগ্রে, ঠিক তেমনি তার সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যক্তি, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও অনেক। আর এই সব কিছুর মধ্যে সমন্বয়ের প্রধান দায়িত্ব একমাত্র রাষ্ট্রের। আমাদের সন্তানদের কর্মক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু মহৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশ্বাস করি একইভাবে দেশের সকল বৃত্তবান এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু এবং ব্যক্তিদের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। অন্যথায় এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে পিছনে ফেলে রেখে টেকসই উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি) অর্জন করা মোটেও সম্ভব হবে না। লেখক : বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ল্যাংগুয়েজ বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×