ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

দেশের দুর্নীতি রোধ করতে হবে

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

দেশের দুর্নীতি রোধ করতে হবে

মনে পড়ছে সেই এক এগারোর কথা। বনানী, গুলশানে অবস্থিত ইংরেজী মাধ্যমে পড়া ছাত্রছাত্রীরা যেসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটিতে ছেলে-মেয়েদের হাতে ইংরেজীতে অনুবাদ করা এক পাতার কয়েক হাজার লিফলেট বিতরণ করেছি। প্রধানত বিএনপি নেত্রী কর্তৃক প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করা, দলীয়, অনুগত ভৃত্যের মতো এক বিচারককে নির্বাচন কমিশন প্রধান করা, সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার সংবলিত ভোটার তালিকা করা, বাংলাভাইসহ জঙ্গী উত্থান ঘটানো, হাওয়া ভবনের দুর্নীতি ও জঙ্গীদের সাহায্যে ২১ আগস্ট হত্যাকা-, শাহ কিবরিয়া হত্যাকা-সহ সারাদেশে বিশ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যা, অনেককে বাড়িঘর ছাড়া করা ইত্যাদি অপকর্মগুলো বুলেট আকারে বাংলায় তৈরি করেছিলাম আমরা পেশাজীবী নারীসমাজের পক্ষে একদল রাজনৈতিকভাবে সচেতন রাজপথে থাকা কয়েকজন নারী। এগুলো আমরা হাইকোর্ট চত্বরে, রাজপথে যাত্রীদের, মার্কেটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এর ইংরেজী ভার্সন তৈরি করে কয়েক হাজার কপি ছাপিয়ে ওগুলো গুলশান, বনানী এলাকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করেছিলাম। এমনি একদিন বিতরণ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ৭টার খবর দেখতে গিয়ে প্রচ- বিস্ময়ের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট কাম সিটিজি প্রধান ইয়াজউদ্দিনের প্রতিদিনের খালেদা নির্দেশিত প্রলাপের স্থলে অবিশ্বাস্য সুস্থ, সুবিবেচনাপূর্ণ বক্তব্য শুনে ভাবলাম, না জানি আবার কি খেলা শুরু হবে। বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা হলো, সবাই বিমূঢ়, বিস্মিত, তবে সবাই বুঝলাম কি ঘটেছে যখন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ জাতিকে নতুন সরকারের কাজ শুরুর কথা জানালেন। ওইদিনই লিফলেট বিতরণ কাজ শেষ হয়। খালেদা, ইয়াজউদ্দিন, তারেক, নিজামী, জয়নুল আবেদীন গংদের স্বেচ্ছাচারী খেলাও শেষ হয়েছে জাতিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যখন উপদেষ্টাদের একদল আসছিল, তারা পদত্যাগ করছিল, আরেকদল আসছিল, তারাও পদত্যাগ করছিল এবং ওদের বর্ণনা মতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত জাতি বার বার শোনে গভীর অন্ধকার টানেলের শেষে একটু আলো দেখা যায়, তখন জাতি আশায় বুক বাঁধে আরেকবার হতাশ হওয়ার আগে। ওই দুঃসহ, জাতির বুকের ওপর চেপে বসা নীতিবর্জিত, ক্ষমতার নেশায় উগ্র লোভী পাকিস্তানের চর ও বাংলাদেশের শত্রুদের জাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে তাদের বাধ্য করেছিল যারা, তাদের কাছ থেকে ওই অন্যায় স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্তি ছিল জাতির প্রথম ও প্রধান প্রাপ্তি। তা না হলে খালেদা-তারেক-নিজামী-ইয়াজউদ্দিনের যৌথ পুতুলনাচ আরও কতকাল চলত এবং তার ফলে ২০০১-এর মতো, বা তার চেয়েও নিকৃষ্ট বানোয়াট ফলের যে নির্বাচন হতো, হত্যাযজ্ঞ চলত, তা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। এরপরের ঘটনা পাঠক জানেন। আমার এ লেখার বক্তব্য হচ্ছে- ওই দুর্নীতিবাজদের পাশে বঙ্গবন্ধু, তাঁর কন্যা, তাঁদের ছেলেমেয়েদের সততা সম্পর্কে আমরা সবসময় নিশ্চিত ছিলাম, আছি। কিন্তু কথা হচ্ছে এত কষ্টের পর পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারপ্রধান সৎ হলে মন্ত্রীরা, সাংসদরা, রাজনীতিবিদরা, আমলারা, ব্যাংকাররা, ব্যবসায়ীরা, শিক্ষকরা, ছাত্ররা, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কি অধিকাংশ সৎ? বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে দুর্নীতি যে ভয়াবহ আকারে বিস্তার লাভ করছে, তা কেউ অস্বীকার করবে না। দু’একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সেদিন আমার গাড়ি চালককে তার ভাই-বোনের, মা-বাবার অবস্থা, পেশা জানতে চাইলে ছেলেটির কাছ থেকে যে উত্তর পেয়েছি, তা আমাকে বিমূঢ় করে দেয়। ওর দু’ভাই মাদ্রাসায় পড়ছে মসজিদের ইমাম হবে বলে। কেননা সাধারণ শিক্ষায় বি,এ, এম,এ পাস করেও লাখ টাকা ঘুষ ছাড়া সরকারী-বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয় না! কথাটা অসত্য, তা কিন্তু নয়। এর ৪/৫ বছর আগে এক চালকের ভাই যে পুলিশের এসআই পরীক্ষার লিখিত অংশে প্রথম স্থান অধিকার করে, তারপরও ওর নিচের অবস্থানে থাকা দুজন অর্থ দিয়ে চাকরি পায়! আমরা জনগণ যারা গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, নানা কেন্দ্রীয় অফিসের বাইরে অনেক দূরে থেকে এসব দেখছি, তাদের সবার একটাই কথা- বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পাওয়া ছাড়া অন্য যে কোন ক্ষেত্রে চাকরি পেতে লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়, এমন কি প্রাইমারি, মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষক হতে গেলেও নাকি সাংসদদের এখতিয়ারে এবং তাদের কাউকে কাউকে অর্থ দিতে হয়! বিদেশ যাবার জন্য তরুণ শ্রমিকদের বক্তব্য প্রায়ই শুনি- সরকার নির্ধারিত ফি-এর তিন-চারগুণ অর্থ দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে যাচ্ছে। একবার আমি এক তরুণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে জানলাম, কোনক্রমেই সরকার নির্ধারিত অর্থে ওই ছেলেকে পাঠানো সম্ভব নয়, কেননা এজেন্টরা ফর্মে লিখবে সরকারী অঙ্ক, কিন্তু শ্রমিককে দিতে হবে তিন-চার গুণ! আমি বিস্ময় প্রকাশ করাতে কর্মকর্তারা আমাকে বোকা ও মূর্খ মনে করে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বললেন আমি এ তথ্যটুকুও জানি না! আমার এ প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছিল, তা না বললেও চলে। সেদিন একজন জানাল, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়নের চাকরির জন্যও লাখ লাখ টাকা দিতে হয়! একজন ধরল, ব্যাংকে ঢুকতে সাহায্য করতে, বললাম খুব ভাল পরীক্ষা দিতে হবে, তারপর দেখি। খুব ভাল পরীক্ষা দিল ছেলেটি, এক ব্যাংকে নয়, পরপর অনেক ব্যাংকে হলো না। জানলাম, ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা কেউ রিকমেন্ড না করলে কেউ কোন ব্যাংকেই চাকরি পায় না, সে সরকারী-বেসরকারী যাই হোক। ছেলেটি কোন ব্যাংকে ভাল পরীক্ষা দিয়েও কখনও মৌখিকের জন্য ডাক পায়নি! চাকরিও হয়নি। আমি বলার চেষ্টা করে কোন উর্ধতনের ফোন ওই সময়ে খোলা পাইনি। গার্মেন্টেও তাই, তবে কোন কোনটি কখনও কখনও ভাল পরীক্ষার ফলকে গুরুত্ব দেয়। শুনতে পাচ্ছি, এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বা শিক্ষক- যারাই হতে চায়, সেটি হয় বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে! আমার চাকরির সময় এজি অফিসে বেতন ফিক্সেশনের কাজটি যদিও অহেতুক, তবু করতে যেতে হয়েছে। প্রত্যেকবার ওরা চা-পানির টাকা চাইত, আর আমি উত্তর দিতাম- এ কাজটাই তো আপনার চাকরি, এর জন্য আপনি সরকারের কাছ থেকে আমার মতোই বেতন পান। একথা শুনে অসন্তুষ্ট কর্মকর্তা অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজটি গড়িমসি করে করত। তবে পেনশনের, প্রভিডেন্ট ফান্ডের চেক ওঠাতে বাধ্য হয়ে কয়েক হাজার টাকা দিয়েছি, নতুবা চেক আটকে ছিল! এগুলো গল্প হলে ভাল হতো। কিন্তু দুঃখজনক এগুলো সব সত্য। বেতন ডবল করেও এর কোন সমাধান হয়নি, দুর্নীতি শেষ হয়নি। বর্তমানে, অর্থাৎ ২০০৯ থেকে আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হিসেবে যখন পরিচিত হলাম, আমাকে অনেকেই গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে দেখেছে, নির্মূল কমিটির সভায় দেখেছে, তখন আমার এলাকার টেলিফোন ক্যাম্পের টেলিফোন দেখভাল করার লোকটি একটি কাজ শুরু করল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার দিন থেকে ফোন অকেজো করে দিল, বড় কর্মকর্তার কাছে দরখাস্ত দিয়ে সপ্তাহখানেক পর ঠিক হলো, তবে মাসে এক সপ্তাহ নষ্ট রাখা নিয়ম হলো। যেদিন কোন যুদ্ধাপরাধীর রায় হয়, সেদিন সকাল থেকে নিয়ম করে এ পর্যন্ত যত রায় হয়েছে, রায়ের দিন থেকে অন্তত এক সপ্তাহ ফোন ডেড রাখা হয়েছে। আমি অভিযোগ করতাম, তারপর ঠিক হতো, এখনও এ ব্যবস্থা বলবৎ আছে। শুনেছি, ওই বৃদ্ধ বয়সেও ওই অপারেটর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সে সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছর চাকরি বৃদ্ধির জন্য নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদন করে সুবিধা লাভ করেছে। সে আরও দুই বছর এ কাজটি করে যাবে! আরেকটি ঘটনা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন এক হাসপাতালের অস্থায়ী পিয়ন আমাকে ধরেছে তার চাকরি স্থায়ী করে দেয়ার জন্য! অন্যরা লাখ টাকা চায়। আরেক ইলেকট্রিক মিস্ত্রি দরখাস্ত করেছে ওই মেডিক্যালে, ওই হাসপাতালের এক কর্মচারী বলেছে জয়েন করিয়ে দেবে, কিন্তু চার লাখ টাকা দিতে হবে। এরা এসেছে আমার কাছে। কেন? কেননা আমি নাকি প্রধানমন্ত্রীকে বলার ক্ষমতা রাখি, প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলার ক্ষমতা রাখি! কেন এমন মনে হলো? ওদের উত্তর, আপনাকে টিভিতে দেখেছি, সবাই বলে আপনি পারবেন। হায় দুরাশা! কি বলবেন, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী? জানি, এই টাকা দিয়ে রাজনীতিকে অসৎ, কঠিন, প্রশাসনিক কাজকর্মকে ঘুষনির্ভর করা শুরু করেছিল জিয়াউর রহমান, দিনে দিনে বাংলাদেশ-বিরোধীদের লোভ-দুর্নীতির কারণে এবং জঙ্গীবাদ বিস্তারের লক্ষ্যে এর বিস্তার বৃদ্ধি পেয়েছে শতগুণ। ব্যাংকগুলোতে মালিকরা গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করছে, ব্যাংকিং ব্যবস্থাও খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। প্লিজ, পরিচালনা পর্ষদে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব দুই সদস্য রাখুন, বাড়াবেন কেন? ওরা কি গ্রাহকদের স্বার্থে কোন পদক্ষেপ নিয়েছে? নতুন ব্যাংকের খারাপ অবস্থা জেনেও অর্থমন্ত্রী আরও ব্যাংকের অনুমোদন দিলে প্রশ্ন করতে হবে, এতে অর্থমন্ত্রীর কি লাভ হবে? যে ব্যাংকগুলো আছে, সেগুলোর ভিত শক্ত করাই তো অর্থমন্ত্রী, সরকারের প্রথম কাজ। সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, খালেদা-তারেক তো বাঙালীর মডেল হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী আপনি, হবেন মডেল। ডবল ডবল বেতন বাড়ালেন, তবু ওরা সন্তুষ্ট হলো না। এখন অর্থ লোভের এই বিশাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করবেন কিভাবে এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। বহু সুহৃদের পরামর্শ- এই এক বছর চাকরি লাভের দুর্নীতি একদম বন্ধ রাখতে হবে, চাঁদাবাজি, সাংসদের দুর্নীতি বন্ধ করে দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়ে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে। কারণ, আর যাই হোক, বাংলাদেশকে বাংলাদেশ-বিরোধীদের হাতে আবার যেতে দেয়া যাবে না, বার বার নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিজয়ী হতে হবে যার কোন বিকল্প নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×