ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ্রেন্দু শেখর ভট্টাচার্য

অভিমত॥ প্রবাসী ভাবনা॥ অন্তরে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

অভিমত॥ প্রবাসী ভাবনা॥ অন্তরে বাংলাদেশ

যতদূর মনে পড়ে সেই ১৯৬২ সালে সুচনা। যুক্তরাজ্যে তখন প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা। ঈড়সসড়হ বিধষঃয ভুক্ত দেশ হতে সেই চাহিদা পূরণ করতে হবে। সিলেট স্টেডিয়ামে চার আনা দামে খড়হফড়হ যাওয়ার ভড়ৎস বিক্রি হচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। লন্ডন যাওয়ার হিড়িক বিশেষত কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে। পুরো আড়ম্বরের নির্যাস একটি গানে প্রকাশ পেল। গানটি বাতাসে আপনা আপনি ভাসত। ‘আইলরে লন্ডনের জ্বর/ঘর বাড়ি সব বিক্রি কর,/তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর/ দিন তো বইয়া যায় রে।’ সেই যে শুরু হলো দেশান্তর হওয়ার এই প্রবাহ কালক্রমে আরও বহু মাত্রায় বৃদ্ধি পেল। অবশ্য সেই ব্রিটিশ আমলেও আমাদের দেশ থেকে জাহাজের খালাসি হয়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ছিল। সময়ের বিবর্তনে এই প্রবণতা শুধু শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না। শ্রমিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এখন বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। দেশের বেকারত্ব, দারিদ্র্য থেকে অতি দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার বাসনা এবং সর্বোপরি প্রজন্ম অন্তর একটি স্বচ্ছন্দ, নিরাপদ, জীবনের সব ইচ্ছা পূরণের প্রত্যাশাও দেশান্তর হওয়ার বাসনাতে প্রণোদনা জুগিয়েছে। এই ইচ্ছা কোন কোন ক্ষেত্রে এমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক বঙ্গ সন্তানের সলিল সমাধিও হয়েছে। যাই হোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিদেশ যাত্রা তো সম্পন্ন হলো। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের আশাতীত সংস্থানও হলো। জীবনের সব বৈষয়িক প্রত্যাশাও পূরণ হলো। কিন্তু তারপর! আমার পর্যবেক্ষণে কিছু পরিচিতজনকে দেখেছি দেশে থাকতে শিক্ষা জীবন অথবা কর্মজীবনে তারা আপন মহিমায় মহিমান্বিত। রাজনীতিবিমুখ, পারিপার্শ্বিক বিষয়ে নির্লিপ্ত, আপন ভুবনেই তাদের বেশি স্বচ্ছন্দ মনে হতো। কালক্রমে তারাও একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্নে, কেউ বা উচ্চশিক্ষার্থে, অথবা অন্য কোন কারণে কাল¯্রােতে দেশান্তর হয়েছেন। তারা এখন প্রবাসী। প্রজন্মসহ তারা এখন শিকড় গেড়েছেন জীবনের ইহলৌকিক সব প্রাপ্তির মধ্যে। অস্তিত্বের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত প্রত্যয়ে তাদের আপন মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটছে একটা অনুকূল পরিবেশে। আমার দেশের এ মানুষেরা বিপুল অবদান রাখছেন বসবাসরত দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদির উন্নয়ন ক্ষেত্রে। এমনকি প্রবাসের রাজনীতির মূল ধারায়ও তাদের অনেকে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারও ফুলে-ফেঁপে স্ফীত হচ্ছে বিদেশে তাদের ঘামঝরা পরিশ্রমের ফসল হিসেবে। কিন্তু বিদেশের জল, হাওয়া, মেশিনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তারা কিন্তু নাড়ির টান ছেদ করতে পারেননি। এত কর্মযজ্ঞের মধ্যে মনোনিবেশ করেও মাঝে মাঝে তারা আনমনা হয়ে যান। দেশের জন্য মন আনচান করে। সময় সুযোগে ছুটে আসেন তারা দেশে, ছায়া সুনিবিড় নিজ আলয়ে। পরিচিত পরিবেশে মিশে যেতে তাদের কত ব্যাকুলতা। পুকুর ঘাটে স্নান করেন, বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন, গ্রামের হাটে যান, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন হাটে-ঘাটে-মাঠে। সবই চিরপরিচিত পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। অতীতকে ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। এরপরও পিয়াসী মন আরও যেন কিছু খুঁজে বেড়ায়। এভাবেই সময় কাটে। ফেরার সময় হয়ে যায়। মনে কিছুটা শূন্যতা নিয়েই ফিরতে হয় সুখের দেশে অতৃপ্ত শান্তিকে পেছনে ফেলে শান্তির দেশ ছেড়ে। এক বুক শূন্যতা নিয়ে শান্তির দেশকে পেছনে ফেলে তারা ফিরে যান আবার সেই ছকে বাধা জীবনে, পরবাসে। এখানে আরাম আছে, স্বাচ্ছন্দ্য আছে, জীবনের নিরাপত্তা আছে, আছে দূষণমুক্ত পরিবেশ। কিন্তু সব পাওয়ার এই স্বপ্নের দেশেও যেন কি নেই! প্রবাসে কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশী প্রবাসীরা একত্র হন। সাত সমুদ্র তের নদীর পারে তারা অবিকল আরেকটা বাংলাদেশ রচনা করেন। সোচ্চার হন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ঘটমান ঘটনা ইত্যাদি বিষয়ে। আয়োজন করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। শিল্প সাহিত্য চর্চা করেন দেশীয় আবহে, মেজাজে। আমার পরিচিত নিভৃতচারী স্বজনদের অজানা সুপ্ত প্রতিভার জোরালো প্রকাশ ঘটতে দেখি প্রবাসে তাদের রচিত শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি চর্চার পরিমণ্ডলে সরব ও সক্রিয় বিচরণে। বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশ পায় দেশ সম্পর্কে তাদের আলোচনা, সমালোচনা, মতামত। এসব কর্মকাণ্ডই দেশের সঙ্গে তাদের একাত্ম থাকার প্রয়াস। ম্যানহাঁটনের বাঙালী অধ্যুষিত কোন রেস্তরাঁয় গিয়ে বসে আলাপ আলোচনা শুনলে মনে হয় আমি যেন বাংলাদেশেই আছি। প্রবাসে থাকা আমার দেশের এই মানুষদের জীবনের শেষ ইচ্ছা থাকে দেশের মাটিতে যেন তাদের প্রাণহীন, বাসনাহীন নিথর দেহটাকে শায়িত করা হয় অথবা দাহ করা হয়। তার শেষ জানাজা যেন স্বজনদের উপস্থিতিতে হয়। পরিশেষে জীবনানন্দ দিয়ে ইতি টানি ‘আমি যে দেখিতে চাই, আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে, পৃথিবীর পথ ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রানে সয়ে।’ লেখক : সরকারী কর্মকর্তা
×