ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুসাহিত্য

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

শিশুসাহিত্য

বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে চন্দ্রাবতী একাডেমি আয়োজিত দু’দিনের শিশুসাহিত্য সম্মেলনটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। উল্লেখ্য, ১৮১৮ সালে ‘দিকদর্শন’ সাময়িকীর মাধ্যমে শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের অভিযাত্রা। এও নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, বাংলা শিশুসাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শিল্পগুণে সমাদৃত। অন্য অনেক কিছুর মতো রবীন্দ্রনাথও এক্ষেত্রে সর্বোত্তম উদাহরণ। এর বাইরেও তিন প্রজন্ম ধরে প্রায় অবিসংবাদী রাজত্ব করেছেন রায় চৌধুরী পরিবারের উপেন্দ্রনাথ, সুকুমার, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ। তৃতীয় পুরুষ তো বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র শিল্পেও স্বীকৃত। এর বাইরেও আরও অনেক দিকপাল ও সাহিত্য মহারথী বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং নিরন্তর করে চলেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে চন্দ্রাবতী একাডেমির দ্বিতীয় বছরের অনুষ্ঠানটির আয়োজন। গত বছর চট্টগ্রামে ছিল এই আয়োজনের সূত্রপাত। এবার সারাদেশ থেকে প্রায় তিন শতাধিক শিশুসাহিত্যিকের যোগদানের উৎসবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বছরব্যাপী ২০০টি বই প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে। চন্দ্রাবতীর প্রকাশনার মান ভাল। শিশুসাহিত্যকে উৎসাহিত করার জন্য এর সঙ্গে জড়িত শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংগঠকদের পুরস্কৃত করার উদ্যোগটিও প্রশংসনীয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী শিশুদের সুকুমারবৃত্তি বিকাশে শিশুসাহিত্যের ভূমিকা এবং এক্ষেত্রে শিশু একাডেমির যে সবিশেষ দায়িত্ব রয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, শিশু একাডেমির ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই যেন নিষ্প্রভ ও ম্রিয়মাণ। বাংলা একাডেমি আয়োজিত প্রতিবছর মহান একুশের বইমেলায় শিশুসাহিত্যের জন্য আলাদাভাবে কিছু কর্নার ও গ্যালারি থাকলেও তেমন উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা চোখে পড়ে না। বাংলা শিশুসাহিত্যের দু’শ’ বছর পূর্তিতে আমাদের অবশ্যই এই দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে হবে। বর্তমানে শিশু ও তরুণ প্রজন্ম মোবাইল, ফেসবুক, ইন্টারনেটে আসক্ত। কেউ কেউ মৌলবাদী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়ছে। এ থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হতে পারে উন্নতমানের বই-পুস্তক ও শিল্প-সংস্কৃতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫২ সালে অথবা তারও আগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই যখন উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল সেই থেকেই জেগে ওঠে বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির সুবাদে ধাপে ধাপে সেই আন্দোলন ও সংগ্রাম দানা বাঁধতে থাকে। এটাই চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে, যার সার কথা ছিল ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তো সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামের ওপর ভাল এবং কালোত্তীর্ণ বইয়ের অভাব অদ্যাবধি প্রকট। এটি বড় বেদনাদায়ক বৈকি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি বড় প্রভাব বিস্তারী অংশ অবশ্যই ভাষা আন্দোলন, মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস, কবিতা ও ছড়ায় এর অনেকটাই বিধৃত হয়েছে। তবে আরও বিস্তৃত ও গভীর দ্যোতনার অবকাশ রয়েছে। এর বাইরেও স্বাধীনতা-পূর্ব ও যুদ্ধকালীন শরণার্থী শিবিরের মানবেতর পরিস্থিতি, যুদ্ধে বিদেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহায়তা-সহযোগিতা, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ড- ইত্যাদি সুবিস্তৃত পরিসরে লেখালেখির যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মের জন্য এসব বিষয়ে প্রামাণ্য বই-পুস্তক অপরিহার্য। বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে হলে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভিত্তিক ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট জানা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা হবে আগামী দিনের দেশের কর্ণধার ও চালিকাশক্তি, তাদের জন্য তা আরও বেশি অপরিহার্য। প্রজন্মের কথা বিবেচনায় রেখে শিশু-কিশোরদের জন্য আরও বেশি মুক্তিযুদ্ধের কথা ও ইতিহাসগ্রন্থ লেখা আবশ্যক। সে অবস্থায় শিশু একাডেমিসহ চন্দ্রাবতী একাডেমি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং প্রকাশনা এ বিষয়ে আরও আন্তরিক ও উদ্যোগী হবে বলে প্রত্যাশা।
×