ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অর্ধেকের বেশির তদন্তই শেষ হয়নি, হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে

অগ্নিসন্ত্রাস মামলাগুলোর তদন্ত চলছে শম্বুকগতিতে

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭

অগ্নিসন্ত্রাস মামলাগুলোর তদন্ত চলছে শম্বুকগতিতে

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি-জামায়াতের চার বছর আগে ডাকা দেশব্যাপী হরতাল অবরোধের নামে পেট্রোল বোমা, বোমা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত এখনও অর্ধেকেরও বেশি শেষ হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এসব ঘটনার হোতারা। ২০১৩ সালে নির্বাচন পূর্ব থেকে ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা পেট্রোল বোমা ও নাশকতার ঘটনায় দেশব্যাপী মামলা দায়ের হয় প্রায় দুই হাজার মামলা। এর মধ্যে পেট্রোল বোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ, নাশকতাসহ সহিংসতার ঘটনায় প্রায় ১ হাজার মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে। চার বছর আগে ২০১৩ সালের এবং ২০১৫ সালের বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা সারাদেশের টানা হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোল বোমার সহিংসতা ও নাশকতা মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের ঘটনা চলছে অত্যন্ত শম্ভুক গতিতে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নাশকতার ঘটনাগুলোর মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে গাড়িতে আবার ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে। চার বছর আগের নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির সহিংস ঘটনাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের ঘটনা শেষ না হতেই আবারও সহিংস রাজনীতির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় পুরনো মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামি ধরার বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ সদর দফতর। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩ সালের শেষভাগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন হরতাল-অবরোধে নাশকতায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। এখন আবার সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধুয়া তুলে সহিংস রাজনীতির জানান দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা। নির্বাচনপূর্ব পেট্রোল বোমার সহিংসতায় ২৫ দিনে পেট্রোল বোমা ও অগ্নিসংযোগে ১৩৩ মানুষ দগ্ধ হয়েছেন, নিহত হয়েছে ২৬। এছাড়া বিভিন্ন সহিংসতায় ৩৮২ বাস-ট্রাকে আগুন, রেলে নাশকতামূলক ১৪ ঘটনায় দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত এবং তিনটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহত এবং পুলিশের ওপর ৮৫ আক্রমণের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের পরিসংখ্যানে উল্লেখ আছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের টানা ৯৩ দিনের অবরোধে সারাদেশে ব্যাপক নাশকতা চালানো হয়। সারাদেশে পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন ও পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। তখন সারাদেশে নারী ও শিশুসহ অন্তত ৯৫ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ৬৪। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন আরও এক হাজার ৪১৩ জন। আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট্রোলবোমায় দগ্ধদের মুখের আকৃতি আদল বদলে যাওয়ায় নিজের সন্তানও কাছে আসে না। এমন অসহনীয় জীবন তারা চান না। ক্ষমতার জন্য যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে তাদের ধিক্কার জানিয়ে এমন রাজনীতি পরিহার করারও অনুরোধ করেছে তাদের অনেকে। বিএনপি জামায়াতের অবরোধের সময় নাশকতায় দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলার তদন্ত চলেছে ধীরগতিতে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে নাশকতার অভিযোগে ১ হাজার ৭৭৫ মামলা দায়ের করা হয়। আসামির তালিকায় রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ মাঠ পর্যায়ের কয়েক হাজার কর্মী। এর মধ্যে যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যার অন্তত চারটি ঘটনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুরে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা আইকন পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে আট যাত্রী নিহত হন। চৌদ্দগ্রাম থানার পুলিশের এক এসআই বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দুটি দায়ের করেন। মামলায় ৫৬ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ২০ জনের কথা বলা হয়। একটি মামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে আসামি করা হয় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এসব মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনেকে এখন জামিনে রয়েছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গাইবান্ধার তুলসীঘাট এলাকায় নাপু পরিবহন নামে একটি বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় আট যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এ মামলা হয় স্থানীয় থানায়। মামলার প্রধান আসামি মোস্তফা মঞ্জিল গত ১৭ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এলাকায় দায়ের করা ৪৫৭ নাশকতা মামলার মধ্যে তিন শতাধিক মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। গত ২৪ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গ্লোরি পরিবহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এ সময় বাসের ভেতর ২৯ যাত্রী দগ্ধ হন, মারা যান একজন। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় এক এসআই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তর হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আরও ৩৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চার বছর আগের দায়ের করা মামলাগুলোর ঘটনায় যারা হোতা তাদের এখনও বিচার হয়নি। এমনকি মূল হোতাদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। নাশকতা ও পেট্রোল বোমার মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার এবং তদন্তে অবহেলার কারণেই তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দাখিল হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তখনকার ঘটনার মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। দেরিতে হলেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পেট্রোল বোমার মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পেট্রোল বোমার সঙ্গে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতাসহ অন্যান্য ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্নসহ আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
×