ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যাত্রী মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড়

শাহজালালে নামকাওয়াস্তে মেডিক্যাল ইউনিট, মেলে না এ্যাম্বুলেন্সও

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭

শাহজালালে নামকাওয়াস্তে মেডিক্যাল ইউনিট, মেলে না এ্যাম্বুলেন্সও

আজাদ সুলায়মান ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক আসা-যাওয়া করেন। আইকাও রুলস অনুযায়ী এত বিপুলসংখ্যক যাত্রীর জন্য একটা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ইউনিট এয়ারপোর্টের ভেতরেই থাকা দরকার অথচ এখানে নেই ন্যূনতম সুবিধাদি সম্পন্ন কোন মেডিক্যাল ইউনিট। ‘স্বাস্থ্য বিভাগ’ নামে নামকাওয়াস্তে একটা মেডিক্যাল ইউনিট থাকলেও তার ওপর নেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে থাকা ওই ইউনিটের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই যাত্রীরা বঞ্চিত প্রয়োজনীয় জরুরী সেবা থেকে। যে কারণে ডেথ ডিক্লেয়ারেশন ছাড়াই দাফন করতে হয়েছে মালয়েশিয়া ফেরত যাত্রী সানাউল্লাহকে। শুক্রবার কুয়ালালামপুর থেকে আসা এই যাত্রী শাহজালালের লাগেজ বেল্টের সামনে অসুস্থ হয়ে পড়েন, পরে মারা যান। এ সময় তাকে দেখার জন্য কোন ডাক্তার পাওয়া যায়নি। দুজন স্বাস্থ্য সহকারীকে সেখানে ডেকে নেয়া হলেও তারা কোন সেবা ও সিদ্বান্ত দিতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়েই ওই যাত্রীকে মৃত মনে করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় স্বজনরা। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। এ ঘটনা মিডিয়ায় ফাঁস হলে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের মেডিক্যাল ইউনিটে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও দুর্ভাগ্যজনক। এমন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মেডিক্যাল ইউনিটে কাগজে-কলমে একটি এ্যাম্বুলেন্স থাকলেও বাস্তবে সেটা কোথায় তা কেউ বলতে পারেননি। বিমানবন্দরের পরিচালক নিজেও কোন দিন ওই এ্যাম্বুলেন্স দেখেছেন কিনা তা বলতে পারেননি। শুক্রবারের ঘটনায় শাহজালাল বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য বিভাগের যে দৈন্যদশা চোখে পড়েছে, সেটা অবিশ্বাস্য। টার্মিনাল ভবনের দোতলায় দক্ষিণ পাশে একটি কক্ষে এই বিভাগ। কক্ষের বাইরে দরজার পাশে লেখা ‘স্বাস্থ্য বিভাগ’। এ বিভাগে কারা, কখন, কিভাবে কী ডিউটি করেন, তাদের দায়িত্ব কী তা জানেন না সাধারণ কোন যাত্রী। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসার কী কী সুবিধাদি রয়েছে তাও জানা নেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষেরও। জানতে চাইলে বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিক্যাল সেন্টার আছে বিমানবন্দরে। যেখানে একটি এ্যাম্বুলেন্সও রয়েছে। তবে ওই এ্যাম্বুলেন্স আমি কোনদিন চোখে দেখিনি। কোন যাত্রী অসুস্থ হলে তাদের খবর দেয়া হয়। এ এ্যাম্বুলেন্স কোন কাজে আসছে না। তাদের কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয় বিভিন্ন সমন্বয় বৈঠকে। তিনি বলেন, সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব মেডিক্যাল উইং থাকলে হয়ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেত। বিমানবন্দরে অনেক সংস্থা কাজ করে, তারা সিভিল এভিয়েশনের অধীনস্ত নয়। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে যাত্রীসেবা নিশ্চিত হবে। তাহলে আপনারা কেন এটা উচ্চপর্যায়ে জানাননি প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অনেকবারই তো বৈঠকে বিষয়টি তোলা হয়েছে। তারা আশ্বাসও দেয়, পরে আর কিছুই হয় না। সালাউদ্দিনের মৃত্যু সম্পর্কে কাজী ইকবাল বলেন, আসলে তিনি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। এ অবস্থায় ফ্লাই করে ঢাকায় এসেছেন, এসেই আরও অসুস্থ হয়েছেন। তারপর তাকে বাইরে নিয়ে গেলে রাস্তায় তার মৃত্যু ঘটে। এখন ডাক্তার কী সেবা দিয়েছে নাকি দেয়নি সেটা তদন্তের ব্যাপার। এটা দেখার দায়িত্বও স্বাস্থ্য বিভাগের, যা সিভিল এভিয়েশনের অধীনে নয়। এপিবিএন সূত্র জানায়, শুক্রবার সকালের এ ঘটনায় বিমানবন্দরের মেডিক্যাল বিভাগের করুণ চিত্র আবারও ফুটে ওঠে। এদিন কুয়ালালামপুর থেকে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন মোঃ সানাউল্লাহ। তিনি প্রথমে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর তিনি ব্যাগেজ বেল্টে এসে নিজের লাগেজ সংগ্রহের সময় শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এ সময় তিনি অন্যদের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার সাহায্য চান। একপর্যায়ে অপর এক যাত্রী বিমানবন্দরের মেডিক্যাল সেন্টারে খবর পাঠান। কিন্তু সেখানে ছিলেন না কোন চিকিৎসক। তবে দুজন স্বাস্থ্য সহকারী সেখানে ছুটে যান। তারা গিয়ে কিছু করতে পারেননি। তাদের কাছে এ্যাম্বুলেন্স সাহায্য চাওয়া হয়। তারা সেটার কোন জবাব দিতে পারেননি। এ অবস্থায় তাকে বাইরে নিয়ে এসে একটি গাড়িতে তোলেন তারই এক নিকটাত্মীয়। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে ওঠানোর পরই সানাউল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। এ অবস্থায় তাকে আর হাসপাতালে না নিয়ে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে চলে যান স্বজনরা। এ সম্পর্কে ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সানাউল্লার পাসপোর্ট নম্বর বিসি ০৩৪৫৬২৪। মেহের আলীর পুত্র সানাউল্লার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। তার বয়স ৩৪ বছর। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে এলে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে ব্যাগেজ বেল্টে এসে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এ কারণে কর্তব্যরত আর্মড পুলিশ সদস্যরা বিমানবন্দরের মেডিক্যাল সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কোন চিকিৎসক সেখানে নেই। পরে মেডিক্যাল সেন্টারের নার্সরা এসে রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তখন এ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায়নি। যে কারণে সানাউল্লাহর ভাগিনা অন্য গাড়িতে করে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। সানাউল্লাহর ভাগ্নে দীন ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি বিগত ৩ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় ছিলেন। তিনি যক্ষ্মা রোগে ভুগছিলেন। শুক্রবার সকালে ৮টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি অন্য যাত্রীর ফোন থেকে কল করে আমাকে বলেন, তুই কই, আমি আসছি। তাকে জানাই, বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছি। তখন মামা বলেন ‘তুই থাক আমি আসছি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও মামা না আসায় চিন্তিত হয়ে পড়ি। সকাল পৌনে ৯টার দিকে মামার কোন খবর না পেয়ে ৩০০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকি। এরপর সেখানেও তাকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলি। পুলিশ তখন জানায়, ভেতরে মালয়েশিয়া থেকে আসা একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনিই ওই ব্যক্তি কিনা দেখার জন্য বলেন। তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি মামার মুখ বেয়ে ফেনা পড়ছে। তিনি নিথর হয়ে আছেন। পরে সেখানকার লোকজন জানায়, তিনি আর নেই। আপনারা তাকে বাড়িতে নিয়ে যান। তখনও সেখানে কোন ডাক্তার দেখা যায়নি। তখন গাড়িতে করে মামাকে নিয়ে যাই। গাড়িতে ওঠানোর পর দেখি তার হাত-পা শক্ত হয়ে আছে, কোন নড়াচড়া নেই। পরে বাড়িতে এনে তার লাশ দাফন করা হয়। ক্ষোভ প্রকাশ করে সানাউল্লাহ বলেন, এত বড় বিমানবন্দর অথচ একজন অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য কোন চিকিৎসক নেই! কোন এ্যাম্বুলেন্সও নেই। মামাকে হাসপাতালে নিতে পারলে হয়ত বাঁচাতে পারতাম। আর্মড পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, যাত্রী সানাউল্লার অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়ার পর বারবার মেডিক্যাল সেন্টারে খবর দেয়া হয়। কিন্তু কোন চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। অনেকক্ষণ পরে নার্স আসেন। তাদের এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে বললেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জানা যায়, আইকাও রুলস অনুযায়ী এ ধরনের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি ওয়েল ইকুপড হেলথ ইউনিট থাকা আবশ্যক। যেখানে সর্বক্ষণিক পালাক্রমে কমপক্ষে ৩ জন ডাক্তার, প্রয়োজনীয় নার্স, জরুরী চিকিৎসক ইউনিট একাধিক এ্যাম্বুলেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। ওই ইউনিটের সঙ্গে বিমানবন্দরের নিকটবর্তী বড় কোন হাসপাতালের সংযুক্তি থাকতে হয়। যাতে বিমানবন্দরে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পর তাৎক্ষণিক রোগীকে ওই হাসপাতালে শিফট করা যায়। কিন্তু এর বিপরীতে শাহজালালের মেডিক্যাল ইউনিটে গিয়ে যা চোখে পড়ল তা খুবই হতাশাজনক। এখানে কখনই কোন ডাক্তারকে জরুরী চিকিৎসায় সাড়া দিতে দেখা যায়নি। শুধু এই ঘটনাই নয়, বছরখানেক আগে শাহজালালে এক মাদকাসক্তের হামলায় একজন আনসার নিহত ও এপিবিএন সদস্য আহত হওয়ার সময়ও কোন ডাক্তার ও এ্যাম্বুলেন্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে একজনকে সিএনজি গাড়িতে এবং অন্যদের এপিবিএনের গাড়িতে করে হাসপাতালে নেয়া হয়। এপিবিএন জানায়, শাহজালালে কখনই কোন জরুরী মুহূর্তে ডাক্তার ও এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। শুক্রবারও সালাউদ্দিন অসুস্থ হওয়ার পর তাকে অনেকক্ষণ বেল্ট এরিয়ায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কোন ডাক্তার মেলেনি। শুধু দুজন স্বাস্থ্য সহকারী এসে দেখার পর তারাও চলে যান। জানা যায়, বর্তমানে শাহজালালের ফায়ার সার্ভিসে একটি এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, যেটি শুধু দুর্ঘটনার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিমানবন্দরের মেডিক্যাল সেন্টার পরিচালিত হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে। সেখানে একটি এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। কিন্তু সেটা কেউ কখনও চোখে দেখেননি। কাজেও আসে না। ওই এ্যাম্বুলেন্স কোথায় থাকার কথা আর কোথায় থাকে সেটা কেউ বলতেও পারেন না। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা যায়, এখানে একটা এ্যাম্বুলেন্স আছে, সেটা সারাক্ষণ ডাক্তাররাই ব্যবহার করেন যানবাহন হিসেবে। এ্যাম্বুলেন্স দিয়েই ডাক্তাররা এদিক সেদিক যাতায়াত করেন। যে কারণে এ্যাম্বুলেন্স কখনই রোগীরা পান না। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে, সিভিল এভিয়েশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার শরিফুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, এ্যাম্বুলেন্স একটা আছে সেটা থাকে ভিআইপি গেটের কাছে। ড্রাইভার সঙ্কটের কারণে এ্যাম্বুলেন্সটা ব্যবহার করা যায় না। চার ড্রাইভারের মধ্যে দুজন সাসপেন্ড, একজন ডেপুটেশনে মন্ত্রণালয়ে, অন্যজন অসুস্থ। কাজেই এটা চালানো যায় না। চিকিৎসাসেবায় গাফিলতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পালাক্রমে এখানে চব্বিশ ঘণ্টা একজন ডাক্তার, তিনজন নার্স, দুজন সহকারী ডিউটি করে। শুক্রবারও ওই রোগীকে খুশি নামের একজন ডাক্তারই তাকে মেডিক্যালে রেফার করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য রাস্তায় তিনি এক্সপায়ার করে যান।’
×