ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শহর ঢাকায় পাহাড়ী জীবন, সযত্নে লালন করা সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭

শহর ঢাকায় পাহাড়ী জীবন, সযত্নে লালন করা সংস্কৃতি

মোরসালিন মিজান পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবন। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। এই জীবন এই সংস্কৃতির ছিটেফোটা উপস্থাপনা এখানে ওখানে নিয়মিতই চোখে পড়ে। রাজধানী ঢাকার মেলাগুলোতে অংশ নিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। তবে এখন শিল্পকলা একাডেমিতে যে মেলা চলছে, আলাদা করে বলার মতো। বিশাল খোলা চত্বরের পুরোটাজুড়ে আয়োজন করা হয়েছে পার্বত্য মেলা। পাঁচ দিনব্যাপী মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় বৃহস্পতিবার। এরপর থেকে দারুণ জমজমাট। ঐতিহ্যবাহী পোশাক কৃষিপণ্য ফলমূল সবজি মসলা রান্না করা খাবারÑ কী নেই! সবই কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। পছন্দের পণ্য কিনছেন। মেলা ঘিরে সমবেত হয়েছেন ঢাকায় অবস্থানরত পাহাড়ীরাও। এভাবে মেলা পরিণত হয়েছে মিলনমেলায়। আগামীকাল ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। দিবসটি সামনে রেখে মেলার আয়োজন করে পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মোট ৯২টি স্টল। খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনের জীবন ও ইতিহাস ঐতিহ্যের আদি উপাদান তুলে ধরা হয়েছে এসব স্টলে। মেলায় পোশাকের একটি বড় সংগ্রহ। অধিকাংশই তাঁতে বুনা। চাকমা সম্প্রদায়ের নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনন খুব চোখে পড়ে। রঙিন কাপড়টি দিয়ে হাল ফ্যাশনের জামাও তৈরি করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি থেকে আসা নারী উদ্যোক্তা নবনীতা বললেন, পিনন চাকমাদের অভিজাত পোশাক। অন্য পোশাক থাকলেও চলবে। না থাকলেও ক্ষতি নেই। পিনন থাকা চাই। পিননের ফর্ম ব্যবহার করে বানানো জামা বাঙালী ক্রেতারাও কিনছেন বলে জানান তিনি। সঙ্গত কারণেই মেলায় প্রাধান্য পেয়েছে শীতের পোশাক। পাহাড়ে শীত বেশি অনুভূত হয়। গায়ে দেয়ার শালগুলো তাই বেশ পুরো। নরম মোলায়েম শালে হাতের কাজ। কেমন যেন মায়া লেগে আছে। যিনি কিনবেন না, দেখা গেল, তিনিও হাত বুলাচ্ছেন! জামদানী মোটিফ ব্যবহার করে কিছু চাদর বুনা হয়েছে। দেখে শাড়ি বলে মনে হয়! কিছু চাদর ‘জালি ডিজাইন’ নামে পরিচিত। মাছ ধরার জাল থেকে ‘জালি ডিজাইন।’ অজস্র ফুকরওয়ালা চাদরের উজ্জ্বল রং। সহজেই আকৃষ্ট করে। তাপসী হ্যান্ডিক্রাফটসের স্বত্বাধিকারী তাপসী জানালেন, তিন পার্বত্য এলাকাতেই এসব শাল তৈরি হয়। এগুলো নিজেদের হাতে বুনা। সব ঘরেই পাওয়া যায়। কোমড়- তাঁতে বুনা শাল আকারে ছোট। বড় শালের বেলায় কয়েকজন একসঙ্গে কাজ করেন বলে জানান তিনি। কৃষিপণ্য ও ফলমূল দিয়ে সাজানো হয়েছে অনেকগুলো স্টল। বিন্নি চাল, ঝুমের আনারস, কমলা, বারমাসী কাঁঠাল, বাংলাকলা থেকে শুরু করে আছে নারিকেল কচুও। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টলে আঁখ শুধু। সচরাচর আঁখের যে রুগ্ন চেহারাটি দেখা যায়, এখানে তার বিপরীত। বেশ হৃষ্টপুষ্ট আঁখ। মিষ্টি কেমন? জানতে চাইলে স্টলের দায়িত্বে থাকা কৃষিবিদ ধনেশ্বর তঞ্চঙ্গ্যা চায়না ভ্যারাইটির কয়েক টুকরো আঁখ মুখে দিয়ে পরীক্ষা করতে বললেন। আসলেই ভারি মিষ্টি রস। এই আঁখের রস দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়েছে। কেমিক্যাল মুক্ত গুড়। স্টলের এক নারী কর্মী বললেন, গুড়ের চাহিদা এত বেশি যে তারা ঢাকায় পাঠাতে পারেন না। মেলায় আছে অনেকগুলো খাবারের স্টল। ঐতিহ্যবাহী খাবার কেউ নিজেরা রান্না করে নিয়ে এসেছেন। কেউ সবার সামনে রান্না করে দেখাচ্ছেন। একটি স্টলের নাম ‘মোজাঙ।’ এখানে পাওয়া গেল ব্যাম্বো চিকেন। সরু বাঁশের ভেতরে মাংস রেখে বাইরে থেকে পুড়িয়ে নেয়া হয়েছে। কলাপতা দিয়ে মুড়িয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিন্নি পিঠা। স্টলের দায়িত্বে থাকা শুভ্র চাকমা জানালেন, এগুলো সমতলে হয় না। পাহাড়ীদের প্রিয় খাবার। ‘হেবাং’ নামের আরেকটি স্টলে ভাঁপে রান্না করা খাবার। মাছও আছে। জুম্ম কিচেনে পাওয়া গেল চাপিলা মাছের হোরবো। মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের পসরা সাজিয়েছিলন উপচিং মারমা। বয়সে তরুণ। বললেন, ঢাকায় থাকি। তাতে কী, নিজেদের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হই না। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। সে লক্ষ্যেই মেলায় অংশ নেয়া বলে জানান তিনি। তিন পার্বত্য এলাকায় প্রচুর মসলা হয়। মেলায় দেখা গেল খাগড়াছড়ির বিখ্যাত হলুদ। তেজপাতা মানেই শুকনো। মেলায় সবুজ তেজপাতা। অবাক চোখেই দেখতে হয়। মেলায় আছে আরও নানা পণ্যসামগ্রী। কৌতূহল নিয়ে ঘুরে দেখছিলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। আমিনুল ইসলাম ও রোজিনা দম্পতি এসেছিলেন টিকাটুলি থেকে। রোজিনা মনে হলো ভীষণ খুশি। কেন? জানতে চাইলে বললেন, ছুটির দিন। এমনি ঘুরতে এসেছিলাম। এসে পছন্দের অনেক কিছু পেয়ে গেলাম। পাহাড়ী জীবন সংস্কৃতি তার ভীষণ পছন্দ বলেও জানান তিনি। পার্বত্য মেলা আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন সকাল ১০টায় শুরু হয়ে শেষ হবে রাত ১০টায়। সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ আয়োজনটিও উপভোগ করার মতো।
×