ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধররা

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধররা

প্রতিভাধর হওয়া আর অতি বুদ্ধিমান হওয়া দুটো আলাদা ব্যাপার। অতি বুদ্ধিমান ভূরি ভূরি আছে। তাতে খুব একটা যায় আসে না। আসল বিষয় হলো সৃজনশীলতা থাকা। কল্পনাকে যে কোন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকা। প্রতিভাধর ব্যক্তিদের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে। এখানেই প্রতিভাধরদের সঙ্গে অতি বুদ্ধিমানদের পার্থক্য। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথাই ধরা যাক। তার অত বিশ্লেষণধর্মী ক্ষমতা ও দার্শনিক গভীরতা ছিল না। তথাপি আমেরিকার আলোকায়নের যুগে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারক কূটনীতিক, বিজ্ঞানী, লেখক ও ব্যবসা স্ট্র্যাটেজিস্টে পরিণত করেছিলেন। ঘুড়ি উড়িয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, আকাশের বজ্র হলো বিদ্যুত। সেই বজ্রকে বশে আনার জন্য তিনি একটা বড় উদ্ভাবন করেছিলেন। বের করেছিলেন বিশুদ্ধ জ্বালানি স্টোভ, উপসাগরীয় স্রোতের গতিপথ, বাইফোকাল গ্লাস, মনোমুগ্ধকর বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি। এলবার্ট আইনস্টাইনও একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। ছোটবেলায় কথা বলা শিখতে দেরি করেছিলেন। এতই দেরি যে বাবা-মা তাকে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। বাড়ির পরিচারিকা তাকে বলত হাবাগোবা। এক আত্মীয় বলত নির্বোধ। কর্তৃত্বের প্রতি তার এক বিদ্রোহীভাব কাজ করত যার জন্য এক স্কুলশিক্ষক তাকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই তিনি প্রচলিত জ্ঞান ও ধারণা সম্পর্কে এমন সব প্রশ্ন তুলতেন যা শিক্ষাঙ্গনের অতি শিক্ষিত লোকেরাও কখনও চিন্তা করেনি। কথা বলতে শেখার কারণে ধীরগতির জন্যই প্রতিটি ঘটনাকে তিনি অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেতেন, যেগুলো অন্যরা ধ্রুব বলে মেনে নিত। আইনস্টাইন একদা বলেছিলেন : ‘সাধারণ প্রাপ্তবয়স্করা স্থান ও কালের সমস্যা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাত না। কিন্তু আমার বিকাশ এত ধীরে ধীরে হয়েছিল যে, আমি যখন ইতোমধ্যে বড় হয়ে উঠেছি সে সময়ই আমি স্থান ও কাল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেছিলাম।’ সে কারণেই জুরিখ পলিটেকনিকে তার ক্লাসের ৫ জন ছাত্রের মধ্যে তিনি চতুর্থ হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সুইস পেটেন্ট অফিসে একজন তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষক হিসেবে খেটে মরার সময়ই আইনস্টাইন সমকালীন পদার্থ বিজ্ঞানের দুটি মৌলিক তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়ে বিশ্বজগত সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। সে দুটি হলো আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব। আর তা করতে গিয়ে তিনি ‘দি প্রিশ্মিপিয়া’ গ্রন্থে আইজ্যাক নিউটনের বর্ণিত অত্যতম মৌলিক একটি ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। আর সেটা হলো আমরা যেভাবেই দেখি না কেন সময় সেকেন্ডে সেকেন্ডে এগিয়ে চলে। আজ আইনস্টাইনের নাম তাই অসাধারণ প্রতিভার সমার্থক। ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজনশীল প্রতিভাধর বলা যেতে পারে লিওনার্দো, দ্য ভিঞ্চিকে। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে। তিনি সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছিলেন। না, নিউটন বা আইনস্টাইনের মতো অতি মানবিক তাত্ত্বি¡ক মেধাশক্তি তার ছিল না কিংবা তার বন্ধু লুকা প্যাসিওলির মতো গাণিতিক ক্ষমতাও তার ছিল না। কিন্তু ভিঞ্চির রোম্বিকুবোক টেহিড্রোনস এবং কয়েক ডজন আরও অন্যান্য বহুমুখী জ্যামিতিক আকারের ছবি বাস্তব রূপ লাভ করে যেগুলো ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কালক্রমে তিনি ভূগোল, এনাটমি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই কাজ করেন। তার ‘ভাইট্রুবিয়ান ‘ম্যান’ ড্রয়িংটি ছিল স্মরণীয় যার জঠরে ছিল ভ্রণ। এ ছাড়াও তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কিছু শিল্পকর্ম তৈরি করে গেছেন। বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে জন্ম হওয়ায় ভিঞ্চি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তিনি বহুলাংশেই ছিলেন স্বশিক্ষিত। আইনস্টাইনের মতো কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তার একটা সমস্যা ছিল। তিনি প্রচলিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং মধ্যযুগীয় গোঁড়ামিকে অগ্রাহ্য করতে শিখেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা যায়। সমস্যা-সমাধান বের করার এই পদ্ধতিটা কোন অংশেই কম বিপ্লবাত্মক ছিল না। এক শতাব্দী পর ফ্রান্সিস বেকন ও গ্যালিলিও গ্যালিলি এই একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এই পদ্ধতি অনুশীলনের কারণে দ্য ভিঞ্চির স্থান সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের ওপরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। মেধাবীরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছে থাকে, যে কারণে অন্য আর কেউ পৌঁছতে পারে না। প্রতিভাবানরা সেই লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করে থাকে, যা অন্য আর কেউ দেখতে পারে না। ভিঞ্চির সবচেয়ে প্রেরণাদায়ক বৈশিষ্ট্য ছিলÑ তার কৌতূহল। নিজের নোটবইতে তিনি উত্তর খুঁজে বের করতে হবে, এমনি হাজারো প্রশ্ন লিখে রেখেছিলেন। যেমন একটা বৃত্তকে কিভাবে চতুষ্কোণ দিয়ে আকৃত করা যায়। এয়োর্টিক ভাল্ব কেন বন্ধ হয়ে যায়, আলো কিভাবে চোখে প্রক্রিয়াজাত হয় এমনি অসংখ্য প্রশ্ন। তার মহৎ লক্ষ্য ছিল আমাদের এই মহাবিশ্ব এবং সেখানে আমরা কিভাবে আছি সেই বিষয়সহ সবকিছুই জানার চেষ্টা করা। আকাশের রং কেন নীল এই প্রশ্ন ছোটবেলা থেকেই আমাদের জাগে। এক পর্যায়ে আমরা এ নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দেই। দ্য ভিঞ্চি এ নিয়ে তার নোটবইয়ে পাতার পর পাতা লিখে গেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে পানির বাষ্পে আলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে নীল রঙের এক কুহেলী শেড তৈরি হয়। আইনস্টাইনও এই প্রশ্ন নিয়ে ধাঁধায় পড়েছিলেন। তিনি আলোর বর্ণালীর বিক্ষিপ্তরূপে ছড়িয়ে পড়ার এক গাণিতিক সূত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। দ্য ভিঞ্চি কখনই পর্যবেক্ষণ থেকে ক্ষান্ত হননি। অনেক ছোটখাটো ব্যাপারও তিনি লক্ষ্য করতেন যা আমরা সাধারণ মানুষরা খেয়াল করি না। যেমন পাত্রে পানি ঢালার সময় তিনি দেখতেন কেমন করে ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়। ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর সময় তিনি বায়ুর ঘূর্ণি পরীক্ষা করতেন। এসব পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি তুলির টানে অসাধারণ কিছু শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন, ব্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট ছবিতে যিশুর পায়ের গোড়ালিতে জর্দান নদীর জলরাশির লহরীর স্পর্শ কিংবা ডিলিউজ বা মহাপ্লাবন হলো তার এমনি ধরনের কিছু শিল্পকর্ম। তিনিই প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে হৃদপি-ের রক্তের আবর্তের কারণে এয়োর্টিক ভাল্ব বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর অঙ্কিত ‘ভাইট্রবিয়ান ম্যান’ হচ্ছে শরীরবৃত্তীয় সূক্ষ্মতার সঙ্গে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের সংমিশ্রণ। বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মধ্যে যে যোগসূত্র এটাই তার এক চমৎকার নজির। কিছু কিছু মানুষ একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। যেমন গণিতে লিওনহার্ড ইউলার কিংবা সঙ্গীতে মোজার্ট। তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক প্রতিভাধর হলেন তারাই যারা প্রকৃতিজুড়ে অনন্ত সৌন্দর্যের মধ্যে একটা ধারা বা ছন্দ দেখতে পান। দ্য ভিঞ্চির প্রতিভা নানা ক্ষেত্র জুড়ে ব্যপ্ত। তিনি বিশীর্ণ দেহগুলোর মুখমন্ডল থেকে মাংস ছড়িয়ে নিয়ে যে পেশীর সাহায্যে ঠোঁট দুটো নড়ে সেটি অঙ্কন করে তারপর বিশ্বের সবচেয়ে স্মরণীয় হাসি সৃষ্টি করেন। এটাই বিখ্যাত মোনালিসার হাসি। তিনি মানব করোটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান, হাড়গোর ও দন্তবাজি স্তরে স্তরে আঁকেন এবং এভাবে সেন্ট জেরোম এই ওয়াইল্ডারনেস ছবিতে সেন্ট জেরোমের দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলেন। তিনি অপটিক্সের গণিত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কিভাবে আলোক রশ্মী কর্ণিয়ার গায়ে আঘাত হেনে ঐন্দ্রজালিক ইলিউশন তৈরি করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন ‘দি লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মে। প্রতিভাধর হিসেবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কার্লবঞ্চ। জিন বিজ্ঞানী এবং জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ক্রিসপারের পথিকৃৎ জর্জ চার্চ অন্তত তাই মনে করেন। বড় বড় অনেক রসায়নবিদ যার হিসেবে ব্যবহারের জন্য নাইট্রোজেন গ্যাসকে এ্যামোনিয়ায় রূপান্তরের ব্যবহারিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হওয়ার পর কার্ল বশ্চ পেরেছিলেন। তার এই উদ্ভাবন মানবজাতির খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে বিপ্লব এনে দিয়েছে। আজ বিশ্বের ৭৫০ কোটি মানুষের মুখে পর্যাপ্ত খাদ্য যোগাতে বিপুল ফসল উৎপাদনে এ্যামোনিয়া যে কি বিশাল ভূমিকা রাখছে তা হয়ত আমরা কেউ ভেবেও দেখছি না। আরেক অসাধারণ প্রতিভাধর মাদাম কুরি। ১৯০৩ সালে ড. কুরি ও তার স্বামী পিয়েরে এটমের অদৃশ্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয় করেন। কুরিই প্রথম এটমের এই বৈশিষ্ট্যর নাম রাখেন রেডিওএ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয়। ১৯১১ সালে কুরি রেডিয়াম ও পোলোনিয়ামের উপাদানাবলী আবিষ্কারের জন্য দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার জেতেন এবং পারমাণবিক রসায়নের যুগের দুয়ার খুলে দেন। তার কন্যা ইরিন জুলিও কুরিও ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধরদের তালিকায় স্টিভ জবসকে অন্তর্ভুক্ত না করলেই নয়। এই মার্কিন উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবককে পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয়। অনেকটা আইস্টাইনের মতো তিনিও কোন সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে হিমশিম খেলে ভায়োলিন বের করে সুর বাজাতেন। জবস বিশ্বাস করতেন, সৌন্দর্যের গুরুত্ব আছে এবং শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয় সবার মধ্যে, সম্পর্কযুক্ত থাকা উচিত। জবস ভারতে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভের জন্য এসেছিলেন। এর ফলে ম্যাকিনটোস থেকে শুরু করে আইফোন পর্যন্ত তার তৈরি প্রতিটি পণ্যের মধ্যে এমন সৌন্দর্য ছিল যা ছিল চরিত্রগতভাবে প্রায় আধ্যাত্মিক। সূত্র : টাইম
×