ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

*নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্ব দু’বছর ধরে রেডলাইনের হাতে, তবু ফাঁকফোকর রয়েই গেছে ষ চোরাচালান হচ্ছে হরহামেশাই, মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে দুই একটি

সিসিটিভির আওতামুক্ত অনেক পয়েন্ট ॥ অরক্ষিত শাহজালাল

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

সিসিটিভির আওতামুক্ত অনেক পয়েন্ট ॥ অরক্ষিত শাহজালাল

আজাদ সুলায়মান ॥ ভিআইপি চেক-ইন পয়েন্টের স্ক্যানার অচল। ৮ নং গেটে নেই ভেহিকল স্ক্যানার। এমনকি নেই ম্যানুয়াল স্ক্যানারও। কার্গো গেটের অবস্থাও একই। এয়ারসাইট থেকে গাড়ি বের হচ্ছে কোন ধরনের চেক ছাড়াই। অথচ গেটে দ-ায়মান আনসার, এপিবিএন, বিমান ও সিভিল এ্যাভিয়েশনের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী। তাদের চোখের সামনে দিয়েই অহরহ বের হচ্ছে গাড়ির পর গাড়ি। কোন্ গাড়িতে কি যাচ্ছে সে সম্পর্কেও নেই কারো কোন ধারণা। আর সিসিটিভির অবস্থা আরও নাজুক। গোটা এয়ারপোর্টের অনেক পয়েন্ট রয়ে গেছে সিসিটিভির আওতার বাইরে। এই হচ্ছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখানে রেড লাইন দু’বছর নিরাপত্তার ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ দায়িত্ব পালন করার পরও রয়ে গেছে নিরাপত্তার ফাঁকফোকর। যে কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাচালান। এ ত্রুটি যে আসলেই উদ্বেগের সেটা স্বীকারও করেছেন খোদ শাহজালালের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম। বলেছেন, এ অবস্থায় চোরচালান চেক দেয়া শতভাগ সম্ভব নয়। যদিও চোরাচালান প্রতিরোধের দায়িত্ব কাস্টমসের। গোটা এয়ারপোর্ট সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টার্মিনাল ভবনের অনেক জায়গাতেই নেই সিসি ক্যামেরার আওতায়। নেই কাস্টমসের স্ক্যানার। এটা থাকাটা খুবই জরুরী। বিশেষ করে ভিআইপিরা যে চ্যানেল দিয়ে বের হন সেখানে নেই কোন স্ক্যানার। শাহজালালের এহেন নিরাপত্তা ত্রুটি যে কারোরই দৃষ্টিগোচর হওয়ার মতো। ভিআইপি যাত্রীরা ইমিগ্রেশন সেরে যে গেট দিয়ে বোর্ডিং ব্রিজ এরিয়ায় পৌঁছেন সেখানে নেই কোন স্ক্যানার। আবার তারা যখন বিদেশ থেকে ফেরেন তখনও তাদের লাগেজ চেক বা স্ক্যান করার কোন উপায় নেই। তারা যান আনচেকড ফেরেনও আনচেকড। একজন ভিআইপির সঙ্গে থাকেন জনাকয়েক অভ্যর্থনাকারী। তারাও আসা-যাওয়া করেন বেপরোয়া। তাদের সঙ্গে থাকা লাগেজ-ব্যাগেজ কিছুই চেক করার কোন উপায় নেই। ম্যানুয়াল বা স্ক্যানার কোন উপায়েই তা চেক করার সুযোগ নেই্। অথচ ভিআইপিদের জন্য ইমিগ্রেশনের সামনেই রয়েছে একটি স্ক্যানার। কিন্তু সেটা রহস্যজনক কারণে অচল করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এ নিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক কাজী ইকবলুুর করিম বার বার তাগিদ দিলেও আমলে নিচ্ছে না কাস্টমস। স্ক্যানারটি মেরামত করা কেন জরুরী তা উল্লেখ করে চিঠি দেয়া হলেও রহস্যজনক কারণে চালু করা হচ্ছে না। গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, প্রায়ই চোরাচালানের মাল ধরা পড়ছে আগমনী হল ও গ্রীন চ্যানেল এরিয়ায়। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যাত্রীরা যখন এখান দিয়ে বের হয় তখন কর্তব্যরত কাস্টমস কর্মকর্তারা কখনও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কখনও উপস্থিতি সন্দেহবশত হওয়ায় সোনার চালান আটক করা হয়। সোনা ছাড়াও আসছে মাদক, সিগারেট, ওষুধ ও অন্যান্য বস্তু। এ খবর ফলাও করে ছাপা হয়। দেশবাসী জানতে পারে। সুনাম হচ্ছে- কাস্টমস খুব ভাল কাজ করছে। কিন্তু ভিআইপি গেট, ২১ নং গেট ও ৮ নং গেট দিয়ে প্রতিদিন যে হারে চোরাচালান হচ্ছে তা কারো নজরে আসছে না। সেদিকে কারো নজরও নেই। সবাই এখানে উদাসীন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি জনকণ্ঠকে বলেন, সর্বশেষ নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় ডিএফটির টিম যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন করে তখন তারা তিনটা গেট সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তারা বিমানবন্দরের কার্গো ও বিএফসিসির নিরাপত্তা ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ২১ ও ৮নং গেট বিষয়ে বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করে। এ সময় তারা এ দুটো গেটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার ও উন্নত করার বিষয়ে মতামত প্রকাশ করে। ওই টিমের যোগাযোগ কর্মকর্তা নাকিব আকবার বিমানের বিএফসিসিতে প্রবেশ এবং বের হবার সময় যেভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় সেটা বিশ্বমানের বলে প্রশংসা করেন। গোটা বিমানবন্দরে এই মানের নিরাপত্তা বজায় থাকা আবশ্যক বলে মন্তব্য করেন। ভিআইপি গেট দিয়ে কিভাবে কোন্ পদ্ধতিতে চোরাচালান হচ্ছে বা কি ধরনের নিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, কোন ভিআইপি যখন সফরসঙ্গী নিয়ে ভিআইপি চেকইন পয়েন্ট দিয়ে বের হয়ে আসেন তখন তার হ্যান্ড লাগেজ চেক বা স্ক্যান করার কোন সুযোগ থাকছে না। অথচ এই কর্নারেই রয়েছে একটি স্ক্যানার। একই অবস্থা হ্যাঙ্গার গেটে। সেখানে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন যৌথভাবে দাঁড়িয়ে ডিউটি করে। তারা সব সময় সব গাড়ি চেকও করতে পারে না। যদি হিউম্যান স্ক্যানার ও ভেহিকল স্ক্যানার থাকত তাহলে এ নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেত না। তবে আশার কথা, জাইকা শীঘ্রই দুটো হিউম্যান স্ক্যানার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। তখন আর এ সমস্যা থাকবে না। পর পর দুদিন হ্যাঙ্গার গেটে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরের এয়ারসাইট ও ট্যাক্সিওয়ে থেকে নিয়মিত অফিসিয়াল গাড়ি বের হচ্ছে। তাদের গাড়িতে কে কি নিয়ে বের হচ্ছে সেটা কেউ বলতে পারছে না। মাঝে মাঝে এপিবিএন কিছু সন্দেহজনক গাড়ি তল্লাশি করে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানকার সব গাড়ি সর্বক্ষণিক তল্লাশির দায়িত্ব কাস্টমসের। চোরাচালানরোধের দায়িত্ব হিসেবেই এই গেটে কাস্টমস সর্বক্ষণিক তদারকির নিয়ম থাকলেও এখানে তেমনটি চোখে পড়েনি। কাস্টমসের এক প্রতিনিধিকে দেখা যায় গেটের পাশের একটি রুমে মাথা নিচু করে বসে থাকতে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিমত, রাতদিন এই হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে বের হচ্ছে বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের অপারেশনাল যানবাহন ও অন্যান্য অফিসিয়াল গাড়ি। এসব গাড়ি বিভিন্ন অজুহাতে বার বার বের হয়। আবার কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসে। এখানেই সন্দেহ। এর মধ্যে ইচ্ছে করলে নিরাপত্তাকর্মীরা সন্দেহবশত অফিসিয়াল গাড়ি মাঝে মাঝে চেক করতে পারে। কিন্তু ভেতর থেকে ময়লার গাড়ি চেক করার কোন সুযোগ নেই। যদি ময়লার গাড়িতে চোরাচালান সম্পর্কে একেবারে শতভাগ নিশ্চিত কোন তথ্য না থাকে তাহলে কেউ তাতে চেক করতেও ইচ্ছুক নয়। এ বিষয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন-শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন দোকানপাট, রেস্টুরেন্টের ময়লা ও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের মলমূত্র ট্রাকে করে বাইরে আনে নাহিদ ট্রেডার্স নামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। এসব ট্রাক দিবারাত ৮নং গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকে আবার বের হয়। কখনই তা চেক করা হয় না। বছর দুয়েক আগে সোনা ও মদের বোতল আটকের পর নাহিদ ট্রেডাসের্র গাড়ি কিছুদিন বিশেষ নজরদারিতে ছিল। এ সম্পর্কে এপিবিএন অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, ময়লার গাড়ি চেক করার উপায় কি? এপিবিএন শুধু দায়িত্ব পালন করে যাতে কোন গাড়িতে করে কোন বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। এদিকে গোটা শাহজালাল বিমানবন্দরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এখনও রয়ে গেছে সিসিটিভির আওতার বাইরে। মূল টার্মিনাল ভবন সহ কার্গো ও হ্যাঙ্গার গেটে বর্তমানে মাত্র ২২০ সিসিটিভি সক্রিয়। অথচ বিমানবন্দরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এর আওতাভুক্ত করতে হলে কমপক্ষে ৫শ’ সিসিটিভি দরকার। গত সপ্তাহে বিমানবন্দরের চারতলায় বিমানের নিরাপত্তা কর্মকর্তা রেজার রুম থেকে পৌনে দুই কেজি সোনা উদ্ধারের ঘটনা তদন্তের জন্য সিসিটিভি খোঁজা হয়। কিন্তু তদন্তকারীদের জানানো হয়, রুমটি ছিল সিসিটিভির আওতার বাইরে। এ সম্পর্কে পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম বলেন, আরও অন্তত ৫ শ’ সিসিটিভি জাইকার অনুদানে লাগানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। হয়ত মাসকয়েক লাগতে পারে। তখন গোটা এলাকাই সিসিটিভির আওতায় আসবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এহেন চিত্রকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, শাহজালালে বর্তমানে নিরাপত্তার নামে চলছে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। এদিকে গত এক বছরে সোনা চোরাচালানের পরিসংখ্যান দেখে এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন রেড লাইন গত দু’বছরে যে কাজ করেছে তাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সিভিল এ্যাভিয়েশন দাবি করছে-পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। একটি এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মানদ- নির্ভর করে অর্থ, বিস্ফোরক দ্রব্য, গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র পাচার এবং চোরাচালানের ওপর। কিন্তু শাহজালালে রেড লাইন কাজ করছে শুধু যেন লন্ডন ফ্লাইটের নিরাপত্তা নিয়ে। ওই ফ্লাইটে বোমাবারুদ ও অস্ত্র নিয়ে কেউ যাচ্ছে কিনা সেটা প্রতিরোধ করার জন্যই কাজ করছে তারা। এ বিষয়ে বিমানের এক কর্মকর্তা প্রশ্ন রাখেন, ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জরুরী ভিত্তিতে রেডলাইন নিয়োগ দেয়া সম্ভব হলেও মাত্র এক কোটি টাকা ব্যয়ে গোটা বিমানবন্দরে সিসি ক্যামেরা লাগায়নি সিভিল এ্যাভিয়েশন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হিউম্যান স্ক্যানার। সেটাই নেই। একটা হিউম্যান স্ক্যানার থাকলে গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থার অর্ধেকটাই সম্পন্ন হয়ে যায়। তিনি বলেন-বর্তমানের শাহজালাল বিমানবন্দর সোনা পাচারের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত। যদিও নিয়মিত চোরাচালানের মাল ধরা পড়ার দুটো অর্থ দাঁড়ায়। প্রথমত, এই এয়ারপোর্ট দিয়ে টাকাপয়সা খরচ করলে অনায়াসে চোরাই পণ্য পাচার করা সম্ভব বলেই স্মাগলারদের কাছে নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে। সেজন্যই প্রতিদিন সোনা আসছে। দ্বিতীয়ত, চোরাচালান আগেও ছিল। এখন নিরাপত্তাকর্মীরা তৎপর বলেই ধরা পড়ছে। এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, শাহজালালে ভিআইপি গেটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসিটিভি ও স্ক্যানার লাগানোর জন্য বিভিন্ন সময় বৈঠকে তাগিদ দেয়া হলেও সেটা করা হচ্ছে না। এটা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা হলে পরিস্থিতি অনেকটাই ভাল হবে। ভিআইপি ও হ্যাঙ্গার গেটে কেন স্ক্যানার নেই জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার প্রকাশ দেওয়ান বলেন, ভিআইপি গেটের স্ক্যানারটা অচল। সচল করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের বিভিন্ন বন্দরের জন্য কিছু স্ক্যানার কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। কিছুটা সময় লাগবে হয়ত। চোরাচালান প্রতিরোধের দায়িত্ব কাস্টমসের হলেও লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়ার দায়িত্ব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। পৃথিবীর সব উন্নত দেশের বন্দরগুলোতে যানবাহন প্রবেশ ও বের হবার সময় চেক করা হয় ভেহিকল স্ক্যানার দিয়ে। কিন্তু এখানে তো তা নেই। হ্যাঙ্গার গেটে যদি একটি ভেহিকল স্ক্যানার থাকত তাহলে ময়লার গাড়িতে সোনা-রূপা যাই থাকত ধরা পড়ত। এখন কে যাবে হাত দিয়ে ওই মানুষের মলমূত্র চেক করতে। নানা সীমাবদ্ধতায় অনেক কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় করা সম্ভব হচ্ছে না।
×