ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিভিন্ন মহলে আলোচনা

সমঝোতা না হলে বিএনপির নির্বাচন বর্জন!

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

সমঝোতা না হলে বিএনপির নির্বাচন বর্জন!

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে নানামুখী চেষ্টা তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এ জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের কাছে দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছে। তারপরও শেষপর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করতে পারে বিএনপি। সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। এর পর উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার যাওয়া-আসার রাস্তায় জনতার ঢল দেখে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। এর পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বিপুলসংখ্যক লোকের উপস্থিতি ঘটিয়ে বিএনপি অনেক দিন পরে হলেও রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করে। কিন্তু সম্প্রতি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার জারির পর দলের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। যদিও পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান খালেদা জিয়া। তবে ইতোমধ্যেই বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বেশ ক’জন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় শাস্তি হয়ে গেলে তারা নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে যেতে পারেন। আর বর্তমান সংবিধান অনুসারে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপিকে কোণঠাসা অবস্থায় থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে গেলেও চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তাই এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার চেয়ে বর্জনের পথেই যেতে পারে বলে বিএনপি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে ইতোমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পথে যায় সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে ২০১৩ ও ২০১৫ সালের মতো আবারও কঠোর আন্দোলনে যেতে পারে। এমন আন্দোলনের জন্য সর্বস্তরের দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করতে যথাসময়ে হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানা গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কাদের সঙ্গে আলোচনা? যাদের কোন ভদ্রতা জ্ঞান নেই, তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কোন দল নির্বাচন করবে আর কোন দল নির্বাচন করবে না, এগুলো তাদের দলের সিদ্ধান্ত। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে আসা প্রত্যেক দলের কর্তব্য। যে দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তারা নির্বাচনে আসবে না। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার রাতেই খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করা হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে আলোচনায় বাধ্য করা হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সরকার যে সংবিধান পরিবর্তন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে বিএনপি মনে করে কোনভাবে নির্বাচনকালীন সরকারের অবস্থান মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকলে আর নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল ভাল করবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে এ ধরনের নির্বাচনের পরিবেশ লক্ষ্য না করা গেলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে কি না এ নিয়ে এখনই আলোপ-আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাই বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে চায়। তবে আওয়ামী লীগ সরকার যদি আবারও ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন করতে চায় তাহলে বিএনপি কিভাবে নির্বাচনে যাবে। সে ক্ষেত্রে রাজপথে আন্দোলন করা ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোন পথ থাকবে না। এদিকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখনও নির্বাচনের সময়ের সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেননি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তবে আরও কিছুদিন সমঝোতার চেষ্টা করে সুবিধাজনক সময়ে নির্বাচনের সময়ের সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি। বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখার খসড়ায় যা রয়েছে তার মধ্যে ওই সহায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো তিন মাস। নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। তবে সহায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে সক্রিয় না থাকেন সে বিষয়টি বিএনপির রূপরেখায় প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এ জন্য দলের ভেতর কয়েক ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। বিএনপির সহায়ক সরকারের রূপরেখায় থাকা একটি প্রস্তাব হচ্ছে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ না করার শর্তে নির্বাচনের সময় সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিন মাসের এই সহায়ক সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। আর আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রপতির অধীন মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দল বিশেষ করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া। এর মাধ্যমে সর্বদলীয় সরকারের আদলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা। এ ছাড়া নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকে সহায়ক সরকারের প্রধানের বিষয়ে প্রস্তাব করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নির্দলীয় ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা সম্ভব। যার ১০ ভাগ টেকনোক্র্যাট কোটায় যেমন স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের দিয়ে কাজ করাতে পারবেন। তবে বর্তমান সংবিধানে থাকা নির্বাচন সময়ের সরকারকে উপেক্ষা করে সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করলে বিএনপি নতুন করে কোন সমস্যায় পড়ে কি না এ নিয়েও দলীয় হাইকমান্ড ভাবছেন বলে জানা গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ইতোমধ্যেই দাবি দাওয়ার লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছে বিএনপি। ইসির সঙ্গে সংলাপকালে লিখিতভাবে তা তুলে ধরেছে দলটি। এর মধ্যে রয়েছে তফসিল ঘোষণার আগেই স্বাভাবিক নিয়মে রাজনৈতিক কর্মকা-ের সুযোগ প্রদান করা, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা, নির্বাচনকালে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা, নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করা, নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ অর্থাৎ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেভাবে সীমানা নির্ধারণ করা, সবার জন্য সমান সুযোগ অর্থাৎ লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা, নির্বাচনের অন্তত এক মাস আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সকল স্তরে রদবদল করা, আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন, প্রিসাইডিং অফিসারসহ ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত সকল কর্মকর্তাকে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা প্রদান, ভোট কেন্দ্রে সকল প্রার্থীর এজেন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের জন্য ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অবাধ সুযোগ রাখা, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ না করা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মামলার নামে হয়রানি না করা।
×