ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

১০ লাখ রোহিঙ্গার ভার পাঁচ ইউনিয়নে

দুর্যোগের ঝুঁকিতে কক্সবাজার

প্রকাশিত: ০৩:২৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

দুর্যোগের ঝুঁকিতে কক্সবাজার

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ পাহাড়ের পাদদেশে ও পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। অতিবৃষ্টির কারণে কয়েক বছর আগে কক্সবাজারে পাহাড় ধসে বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এত অধিক রোহিঙ্গার কারণে দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য স্থানীয়দের কী অবস্থা হবে, এ আশঙ্কায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সচেতন মহল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, স্বদেশে ফেরত পাঠানো শুরু না হওয়ায় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ওসব রোহিঙ্গা বসতিকে আপাতত সরানো যাচ্ছে না। তাছাড়া এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে পর্যটন শহরের অন্তত ১০টি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না অবৈধ বসতিদের। এ কারণে কক্সবাজার দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য জেলায় বর্তমানে ৫৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ওইসব আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৬ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। টেকনাফ ও উখিয়ায় ১’শটি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া যাবে মাত্র ৯৫ হাজার মানুষ। সেখানে বর্তমানে স্থানীয়রা ছাড়াও বসবাস করছে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আশ্রয় নিতে গ্রামবাসীদের কোথায় ঠাঁই হবে? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে। জেলার ৮ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায়। সবচেয়ে কম আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে রামুতে। সেখানে কয়েকটি পুরনো পরিবার ছাড়া যত্রতত্র রোহিঙ্গাদের বসতি নেই বললে চলে। কুতুবদিয়ায় ১১০টি, রামুতে ৩১টি, চকরিয়ায় ৮০, পেকুয়ায় ৭১, মহেশখালীতে ৮৫টি, কক্সবাজার সদরে ৬১, টেকনাফে ৫৯ ও উখিয়ায় ৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। গত তিন মাস ধরে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, পাহাড় কাটা ও বনজসম্পদ ধ্বংস করে লাখো বসতি গেড়েছে রোহিঙ্গারা। অনুপ্রবেশের পর তারা কোন ধরনের ভয়ভীতি এবং আইনের তোয়াক্কা না করে যে যেখানে ইচ্ছে, গাছ ও পাহাড় কেটে বসতি গেড়ে বসেছে। পরবর্তীতে সরকার নির্ধারিত আশ্রয় কেন্দ্রে ওসব রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়ায় কিছু কিছু পাহাড় ন্যাড়া অবস্থায় কালের সাক্ষী হিসেবে পড়ে আছে। এমনকি সামাজিক বনায়নও ধ্বংস করে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। এদিকে নগদ টাকা ও ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু রোহিঙ্গা নাফ নদীতে জাল ফেলে মাছ শিকার করে চলছে। এমনকি তারা নেট বসিয়ে নদীর রেনু পোনা পর্যন্ত নিধন করে চলছে। এতে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য ভবিষ্যতে মাছের আকাল দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞজনরা। সুযোগ বুঝে মৎস্য ঘের থেকে জাল ফেলে চুরি করে মাছ ধরে নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় জনগণের জন্য ক্ষতিকর এসব অন্যায় কাজ করে চললেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কেউই টু-শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না। কেননা কেউ প্রতিবাদ করলে মিথ্যা অভিযোগ এনে ওই রোহিঙ্গারা গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে নালিশ করে থাকে এনজিও কর্মী ও প্রশাসনের কাছে। ওসব হয়রানি ও ঝামেলা এড়াতে স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের নানা রকমের অন্যায় চোখবুঝে সহ্য করে চলছে বলে জানা গেছে। ইতঃপূর্বে নয়াপাড়া ক্যাম্পে অবৈধ দোকান নির্মাণ করতে বাধা দেয়ায় রোহিঙ্গারা পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশের এসআইকে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তারা ছুরিকাঘাত ও গলা কেটে হত্যা করেছে লেদা এবং খুনিয়াপালং এলাকার দুই যুবককে। সচেতন মহল বলেন, গত তিন মাস ধরে রোহিঙ্গারা যেসব কচি চারাগাছ কেটে বনজসম্পদের ক্ষতি করেছে, তা হয়ত নতুন করে বাগান সৃজন করলে অদূর ভবিষ্যতে কিছুটা হলেও ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। তবে যেসব পাহাড় কেটে বিলীন করে দেয়া হয়েছে, তা কখনও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।বর্তমানেও রোহিঙ্গারা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে বনাঞ্চল এবং প্যারাবন সাবাড় করে দিচ্ছে। সরকারের কাছে দাবি তুলে অভিজ্ঞ মহল বলেছেন, যেভাবে হোক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে দ্রুত ফেরত পাঠানো অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। স্বদেশে ফেরত পাঠানো বিলম্ব হলে ছোট অঞ্চল উখিয়া-টেকনাফ থেকে সরিয়ে সকল রোহিঙ্গাকে ভাসানচর-ঠেঙ্গারচরে হস্থান্তর করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নির্ধারিত স্থানে বসবাস ঠিক করে দেয়া হলে এতে বনজ সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের উস্কানিদাতা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া যে কোন অনাকাক্সিক্ষত বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি থেকে স্থানীয়দের রক্ষা করা যাবে। পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব জানান, রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। তবে সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা পাহাড় কাটা বন্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। টেকনাফের হ্নীলায় রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে অংশীদারিত্বে সৃজিত ৭৫ একর সামাজিক বনায়ন ধ্বংস করে রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন করার প্রতিবাদে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বৃহস্পতিবার সামাজিক বনায়নের অংশীদারগণ রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ক্যাম্প ইনচার্জ বরাবরে আবেদন দাখিল করেছে। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে সৃজিত ৭৫ একর সামাজিক বনায়নের বিভিন্ন জাতের ৮৫ হাজার চারা গাছ ধ্বংস করে রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন করায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি নষ্ট হয়েছে রোপিত ৮৫ হাজার চারা গাছ। এতে ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি। সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের ক্ষতি হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। বর্তমানে ৭৫ জন উপকারভোগীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে ৫ জন ও কোমেনের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। সচেতন মহল জানান, এ জেলায় ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধস, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল, বজ্রপাত, নদীভাঙন, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। জেলার ৭১টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার মধ্যে ৪১টি ইউনিয়ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ২৪টি ইউনিয়ন বেশি দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ বলা হলেও বর্তমানে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে টেকনাফ ও উখিয়ার ৫টি ইউনিয়ন। উখিয়ার রাজাপালংস্থ কুতুপালং, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইকং, হ্নীলা ও শামলাপুর ইউনিয়নগুলোতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বসতির কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
×