ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্ময়কর উদ্ভাবন ধান ‘চারুলতা’

প্রকাশিত: ০২:৩৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

বিস্ময়কর উদ্ভাবন ধান ‘চারুলতা’

জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সহনশীল নতুন এক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন কৃষক দিলীপ তরফদার। স্থানীয় খেজুরছড়ি ও কুটে পাটনাই জাতের ধান শংকরায়নের মাধ্যমে এই জাত উদ্ভাবন করেছেন তিনি। দিলীপ তরফদার এই নতুন ধানের নাম দিয়েছেন তার মায়ের নামে ‘চারুলতা’। জন্মদাত্রী মা মারা যাওয়ার পর এই চারুলতাই তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। দিলীপ তরফদারের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় মিঠা চন্ডিপুর গ্রামে । কৃষক দিলীপ তরফদারের চারুলতা ধান খেজুরছড়ি ও কুটে পাটনাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদনশীল সক্ষম। এমনকি বিআর ২২ ধানের চেয়ে বেশি ফলন দেয়। এর উৎপাদন খরচও তুলনামূলক কম। গাছ তুলনামূলক শক্ত, তাই সহজেই হেলে পড়ে না। শংকরায়নের পর চলতি আমন মৌসুমে সাত বছর পেরিয়েছে চারুলতা ধান। এই ধান জলাবদ্ধ এলাকায় চাষ করে উপকার পেতে পারেন সাধারণ মানুষ এমন দাবি দিলীপ তরফদারের। ইতোমধ্যে তার এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চায় বিশেষ অবদান রাখায় দিলীপ তরফদারকে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন দিয়েছে স্বাধীনতা সম্মাননা-২০১৬। কৃষক দিলীপ তরফদার চলতি মৌসুমে এক বিঘা জমিতে চারুলতা ধানের (সপ্তম জেনারেশন) গবেষণা প্লট করেছেন। লম্বা শীষে শীষে ভরে উঠেছে তার ধান ক্ষেত। আশপাশের প্লটের ধান নুইয়ে পড়লেও চারুলতা রয়েছে শীষ উঁচিয়ে। দিলীপ তরফদার জানান, রোপা আমন মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী ধানের জাত চারুলতা। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজতলা তৈরির মাধ্যমে এর আবাদ শুরু হয়। আর শেষ হয় অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার মাধ্যমে। চাষাবাদের সময়কাল বিআর ২২ ও কুটে পাটনাইয়ের সমান হলেও খেজুরছড়ি থেকে ১৫ দিন কম। খেজুরছড়ি, কুটে পাটনাই বা বিআর ২২ উৎপাদনে যে পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, চারুলতা উৎপাদনে লাগে তার অর্ধেক। খেজুরছড়ি জাত ধানে যেখানে বিঘা প্রতি ৮ থেকে ১০ মণ, কুটে পাটনাইয়ে ১২ থেকে ১৩ মণ এবং বিআর ২২-এ ১৮ মণ ধান পাওয়া যায়, সেখানে চারুলতার উৎপাদন ২০ থেকে ২২ মণ। ধানের শংকরায়নে মায়ের ভূমিকা পালনকারী খেজুরছড়ির গাছ বেশ বড় এবং বাবার ভূমিকা পালনকারী কুটেপাটনাই ধান তার থেকে আকারে কিছুটা ছোট হলেও তাদের থেকে উদ্ভাবন নতুন জাত চারুলতার আকার আরও ছোট। এর গাছ বেশ শক্ত হওয়ায় সহজে হেলে পড়ে না। শীষের গাঁথুনি খুব ঘন, শীষ অনেক লম্বা, শীষে ধানও বেশি হয়। স্থানীয় অনেকেই দিলীপ তরফদারের কাছ থেকে চারুলতার বীজ নিয়ে জলাবদ্ধ জমিতে চাষাবাদ করে পেয়েছেন সফলতা। ধান জাত উদ্ভাবন নিয়ে কৃষক দিলীপ তরফদার জানান, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) থেকে শংকরায়নের প্রশিক্ষণ নেন তিন। এরপর ২০১০ সাল থেকেই শুরু করেন ধান জাত উদ্ভাবনের কাজ। এজন্য বেছে নেন স্থানীয় জাতের ধান খেজুরছড়ি এবং কুটেপাটনাই। শংকরায়ন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, লবণাক্ত এলাকার জমিতে চাষ করা দুটি জাতের দু’গোছা ধান তুলে এনে মাটিসহ বালতির ভেতরে রেখে তিনি কাজ শুরু করেন। এরপর মা গাছের শীষ তিন ভাগের একভাগ বের হওয়ার পর শীষটি পুরো বের করা হয়। পরে শীষের মাঝামাঝি স্থানের ১৫-২০টি ধানের ভেতর হতে পুরুষ অংশ বের করা হয়। এরপর শীষটি কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পরদিন পুরুষ জাতের শীষ নিয়ে আগের দিনের মা গাছের কাটা শীষের উপর ঝাঁকিয়ে পরাগায়ন করা হয়। পরপর দুদিন একই কাজ করা হয়। পরাগায়নের পরই কাগজের প্যাকেট দিয়ে শীষটি ঢেকে দেয়া হয়। এর ছয়-সাতদিন পর প্যাকেট খুলে দেখাযায় ধানের মধ্য সবুজ চাল হচ্ছে। এরপর আবারও কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে সাবধানতার সঙ্গে রাখা হয়। এভাবেই চারুলতার শংকরায়ন সম্পন্ন হয়। যার উৎপাদন আমন মৌসুমে চাষকৃত অন্যান্য ধানের চেয়ে বেশি, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সহনশীল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) এর কৃষিবিদ পার্থ সারথী পাল বলেন, চারুলতা ধান সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি জাত। তার উদ্ভাবন সত্যিই বিস্ময়কর। -মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে
×