ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ হিপোক্রেসি ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠুক বিজয় চেতনা

প্রকাশিত: ০২:২৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ হিপোক্রেসি ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠুক বিজয় চেতনা

বাংলাদেশের বিজয় দিবস আর সব দিনের চেয়ে আলাদা হওয়ার পরও বিদেশে এ নিয়ে মাতামাতি কম। বলব অন্য দিনগুলো যেভাবে পালিত হয় বা যে উৎসাহ দেখি সে তুলনায় এটি সাদামাটা। এর কারণ খুঁজে পেতে হবে। এত বছর পর আমরা যদি সত্যের মুখোমুখি না দাঁড়াই আমাদের ইতিহাস বা জীবন কোনটাই শুদ্ধ হবে না। মধ্যবয়সী আর মধ্যবিত্ত মানুষের সঙ্গে আলাপ করে আমি এই ধারণায় পৌঁছেছি ভারতের কাছে পাকিস্তানী সেনাদের পরাজয়, যৌথ অর্থাৎ মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিষয়টি অনেকের কাছে মিশ্র অনুভূতির। নিজের দেশের জন্য টান আছে, ভালবাসা আছে এবং থাকবে। কিন্তু এখানেও ধর্ম সম্প্রদায় আর ভারত বিদ্বেষ কাজ করে। এক ধরনের জটিল সমীকরণে ভারতীয় সেনাদের কাছে পাকিদের অসহায় আত্মসমর্পণ ভেতরে ভেতরে অনেকের না পছন্দ। যে কারণে আমাদের সবচেয়ে আনন্দ আর উদ্বেলের দিনটি বাইরের দুনিয়ায়ও নিছক সাদামাটা। এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি তথা হিটলার বাহিনীর পরাজয়ের দিনটিই দুনিয়ায় মুক্তি দিন হিসেবে পালিত হয়। রাশিয়াসহ নানা দেশে এর চেয়ে বড় বিপ্লবের দিন আর নেই। ভেবে দেখলে বাংলাদেশেও তার হিসাব মিলবে। আমাদের সরকারী দল আওয়ামী লীগ মুখে যত বড় বড় কথা বলুক ইতিহাস নিয়ে তাদের মাথাব্যথা আসলে কম। থাকলে ১৬ ডিসেম্বর হতো সবচেয়ে দামী আর গুরুত্বপূর্ণ দিন। জৌলুস বা ঘটা করে উদযাপনে প্রমাণ হয় না দিনটি জাতির জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে। আরও একটি লেখায় লিখেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম হওয়া উচিত ছিলÑ বিজয় উদ্যান। সেটা হলে বিএনপি বা তাদের সমমনাদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ত। তাদের দলের প্রধানকে তারা বলেন স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি নাকি সর্বেসর্বা! একটি ঘোষণাপত্র পাঠ যে আসলে পাঠক ব্যতীত আর কিছুই না সেটা ১৬ ডিসেম্বরেই দেখি আমরা। সেখানে তার কোন দরকার পড়েনি। কে না জানে বঙ্গবন্ধু থাকলে তাঁকে বাদ দিয়ে কোন সারেন্ডারের আয়োজন করার সাহস ছিল না কারও। সেখানে জিয়াউর রহমান ছিলেন এক সেনা অফিসার যিনি আরও সেনা অফিসারদের মতো ভারতের কোথাও বসে আত্মসমর্পণের খবর জেনেছিলেন মাত্র! সেই পড়ন্ত বিকেলে মাঠে থাকা মানুষ একে খন্দকারও শেষ বয়সে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সঠিক কথা থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছেন। সামরিক আর জনযুদ্ধের সংঘাতে আওয়ামী ছায়ায় মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি এটিকে সামরিক দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেনÑ এই যে বিকৃতি এই যে দোদুল্যমানতা এসবের কারণেই বিজয় দিবসকে জানা ও বিশ্লেষণ করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের বড় গৌরবের দিন এটি। ডিসেম্বর মাসব্যাপী নানা ধরনের আলোচনা আর বিজয়ের মাস বলা জাতি, তারুণ্যকে জানতে দেয় না কোন্ পরিস্থিতি আর কোন্ বাস্তবতায় সেই সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানের মতো কাগজে স্বাধীন বা চুক্তিতে স্বাধীন না হয়ে নিজ ভূমিকায় একটি স্বাধীন দেশের অধিকার লাভ করেছিল? এমনকি আত্মসমর্পণের পরও আমাদের কৃতী মানুষেরা বলী হয়েছিলেন। প্রাণ দিয়েছিলেন আরও মানুষ। আজ যখন আওয়ামী লীগ সরকারে বলিষ্ঠভাবে আছে জাতি কি এই জায়গাটা আরও বেশি পরিষ্কার করে জানার অধিকার রাখে না? আজ আমাদের সঙ্গে ভারতের যে টানাপোড়েন সেদিন তা ছিল না। ভারত রাশিয়ার পাশে না দাঁড়ালে আমেরিকা চীন আর পাকিস্তানের বলয় ভেদ করে স্বাধীন হতে পারতাম না আমরা। বিজয়ের মাস নিয়ে গর্ব ও আনন্দের বিষয়টা আমাদের দেশে এখন মেলানির্ভর। মনে হচ্ছে এটি কোন মামুলি দিন। এ নিয়ে সপ্তাহ কিংবা মাসব্যাপী মেলা করলেই মনে হয় দায় চুকে গেছে। আমাদের মনে আছে একেক সময় মনে হয়েছিল বিজয় হয়ত ধরাই দেবে না। ষড়যন্ত্র সমঝোতা কনফেডারেশন আরও কত ঝামেলা! মোশতাক গং তখন থেকে সক্রিয়। ভাসানীর ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত। চার জাতীয় নেতা বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল আর তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন দৃঢ়। তারা কোনভাবেই আপোস বা মাথা নোয়ানোর দিকে যাননি। সেই নেতাদের আমরা সেভাবে সামনে আনিনি। জানি না কেন তাদের বিষয়ে সরকারী দলেও কেমন জানি রাখ রাখ ঢাক ঢাক ভাব আছে। এরা যত সামনে আসবেন ইতিহাস তত পরিষ্কার হবে আর দেশের শাসনভার নিয়ে বিকৃতি ও অন্ধকার টেনে আনা শক্তি তত দুর্বল হবে। বাইরের দুনিয়ায় দেখছি মানুষের মনে নতুন নতুন দুর্ভাবনা। তাদের ধারণা, ভারত জোর করে নাকি অনেক কিছু করেছিল, যা আমরা চাইনি। কি চাইনি আমরা? বায়ান্ন থেকে একাত্তর বিএনপি বা এরশাদের কাছে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হতে পারে। ইতিহাসে এগুলো মালার মতো। অনেক ফুল মিলে যেমন মালা হয় তেমনি এই ঘটনাগুলোই একসঙ্গে হয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। যার মূলমন্ত্র পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্তি। সে মুক্তির জন্য যে প্রাণ বিসর্জন আর ত্যাগ তার সঙ্গে আজকের মানসিকতার দুস্তর ব্যবধান। সে কারণেই বলি, আর একবার সুযোগ পেলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ইতিহাসকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে, যখন হয়ত আর ফেরাই যাবে না। সরকারী দলে থাকা আওয়ামী লীগের বর্তমান ভূমিকা দেখে মনে হয় মোড়ে মোড়ে মাইক লাগিয়ে গান বাজালেই মানুষের চেতনা ফিরে আসে বা তারা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরে যায়। বরং তার উল্টো। মনে রাখতে হবে সব কিছুর সময় থাকে। একাত্তর অনেক আগের একটা সময়। সে জ্যোতি বা আলোর মানুষগুলোর অনেকেই এখন গত। যারা আছেন তাদেরও বয়স হয়েছে। তাদের সবার ভূমিকা বা কর্মকা- যে এক ছিল তাও না । খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। ড. কামাল হোসেনের কথাই ভাবুন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানে থাকা এবং তাঁরই সঙ্গে নিরাপদে ফিরে আসা, এসে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাওয়া মানুষও আজ পথহারা। কোথায় কখন কি বলেন বোঝা মুশকিল। শেখ হাসিনার সরকারকে ঠেকানোর জন্য জোট করছেন তাদের সঙ্গে, যারা মনে করেন জিয়াউর রহমানই মুক্তিযুদ্ধের মূল মানুষ। কামাল হোসেন. তাহলে তো আপনার সারা জীবনের রাজনীতিই ভুল। অথবা আপনি ছিলেন ভুল পথে? ক্লিয়ার করুন আপনাদের ভূমিকা!!!
×