ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিল্টন বিশ্বাস

জাতির পিতার স্মরণে শোকগাথা

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

জাতির পিতার স্মরণে শোকগাথা

মিজানুর রহমান জোদ্দার সম্পাদিত ‘জাতির পিতার স্মরণে : শোকগাথা’ গ্রন্থে ৬৬ জনের ৮৬টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। মিজানুর রহমান জোদ্দার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। বাল্যকাল থেকে তিনি সাহিত্যপ্রেমী। ছড়া ও কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্য চর্চার সূচনা। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, বাঙালী সংস্কৃতি তাঁকে খুব বেশি করে টানে। এজন্যই বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতামালা নিয়ে তাঁর এই সম্পাদনা গ্রন্থ। নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’ দিয়ে শুরু, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তিন কবির তিনটি কবিতা দিয়ে শেষ হয়েছে বইটি। অমিতাভ মৈত্র রচিত ‘তোমার পবিত্র রক্ত’, বিশ্বজিৎ ম-লের ‘বঙ্গ রাখাল’ এবং বিদ্যুত লেখা ঘোষ রচিত ‘ধ্রুবতারার জন্ম’ পশ্চিমবঙ্গের কবিতা। নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তাঁর প্রশস্তিমূলক কবিতা রচনা করেননি; এমনকি ‘বাকশাল’ গঠনকে মেনে নিতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন তিনি। (ভূমিকা, নির্মলেন্দু গুণ, মুজিবমঙ্গল, ২০১২, মিজান পাবলিশার্স) কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আহত হৃদয়ে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রথম বাংলা ভাষার কবিতাটি লিখেছিলেন তিনিই। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মতো ‘জাতির পিতার স্মরণে : শোকগাথা’ সংকলনের অধিকাংশ কবি বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন চরণের পর চরণ সাজিয়ে। সেইসব কবিতা থেকে আমরা প্রমাণ পাচ্ছি বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মধ্যে কত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা কিংবা পরবর্তী স্বৈরশাসকরা জাতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বেঈমানি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ ছিল এই সচেতন কবিদের লেখনি। কবিদের চেতনায় মহামানবের বিশ্বাস ঢুকে পড়েছিল। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু কোন দুর্নীতি করেননি এবং ভারতের কাছে দেশকে বিক্রি করে দেবার অভিযোগও ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে। তবে অপপ্রচার ছিল ভয়াবহ। সেই বিরুদ্ধশক্তির অপপ্রচারে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি। বরং কবিদের রচনা ও মননশীল লেখকদের বিশ্লেষণ বঙ্গবন্ধুকে আরও বিস্তৃত করেছিল জনগণের মধ্যে। বিশিষ্ট কথাকাররা কবিতা লিখেছেন তাঁকে নিয়ে। ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে অসংখ্য এলিজি রচিত হয়েছে। শেখ মুজিব ও রাসেলকে কেন্দ্র করে মর্মন্তুদ কবিতা লেখা হয়েছে। প্রধানত হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শিহাব সরকার, রবীন্দ্র গোপ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, ওবায়েদ আকাশ, মিহির মুসাকী, কামরুল ইসলাম, মিলটন রহমান, লিলি হক, রঞ্জনা বিশ্বাস, খালেদ হামিদী এবং হাফিজ রশিদ খান মৃত্যুর পরও বঙ্গবন্ধুর শাশ্বত উপস্থিতি বাঙ্ময় করে তুলেছেন কবিতার চরণে চরণে। কারণ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু তাঁকে আর ভুলতে দেয়নি। ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যখন এদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ ছিল প্রায় নিষিদ্ধ, তখন সামরিক শাসনের ভ্রƒকুটিকে তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধুর কথা প্রথম এবং প্রকাশ্যে শিল্প-সাহিত্যে উচ্চারিত হয়। যে সময়ে নির্মলেন্দু গুণ ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম নিয়েছিলেন সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে শুধু সাহসের প্রয়োজন হতো না, দুঃসাহসও প্রয়োজন ছিল। নির্মলেন্দু গুণ জাতির ক্রান্তিকালে সেই দুঃসাহসিক ঘটনায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।’ নির্মলেন্দু গুণের উত্তরাধিকার বহন করছেন উল্লিখিত কবিগোষ্ঠী। এর মধ্যে মিহির মুসাকীর ‘অশ্রু সংবরণ করি’ উল্লেখ্যযোগ্য কবিতা (পৃ: ২৮)। শরীফ সাথীর দুটি কবিতা যথাক্রমে ‘বাংলাদেশের তাজ’ এবং ‘অর্ধনমিত পতাকা’ গরুত্বপূর্ণ রচনা। অন্যদিকে এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা হামিদুল আলম সখার ‘মহাকাব্যের মহাপুরুষ’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে প্রাণীত হওয়ার কথা আছে- ‘মেঘ কেটে গেলে আবার সকলে জাগরিত হই/ইথারে ভেসে আসে তাঁর বজ্র-আহ্বান/বাঙালীর মহাকাব্যের মহাপুরুষের/আদর্শে নিজেরে করি দান। (পৃ: ৮৮) মূলত মিজানুর রহমান জোদ্দার সম্পাদিত ‘জাতির পিতার স্মরণে : শোকগাথা’ গ্রন্থে সংকলিত কবিতায় অভিব্যক্ত হয়েছে মহিমান্বিত ও মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু। সাড়ে সাতকোটি বাঙালীকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করেন। স্বাধীন দেশ তারই অমরকীর্তি। জাতির জনক বাংলার মানুষকে সাহসী করে তুলেছিলেন। নিজেদের অধিকার আদায় করে নেবার জন্য পাকিস্তান স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮ থেকে ধীরে ধীরে তার বিকাশ, একাধিকবার তিনি বন্দিত্ববরণ করেছেন; নির্যাতন নিপীড়ন চলেছে তাঁর ওপর। জীবদ্দশায় এবং পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুর মহিমাকে ভাস্বর ও দ্যূতিময় করেছেন একাধিক কবি। তারই সাক্ষ্য রয়েছে এই সংকলনের প্রতিটি কবিতায়। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য। জাতির পিতার স্মরণে : শোকগাথা, সম্পাদনা : মিজানুর রহমান জোদ্দার, অধিকোষ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা, প্রচ্ছদ : সজল, সখা, সাফী, ২০১৭, মূল্য : ৫০০ টাকা।
×