ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়

বাবা-মার স্নেহছায়ায় সন্তান বড় হয়, মানসিক বিকাশ সুস্থভাবে অর্জনের ক্ষেত্রেও এর কোন বিকল্প নেই। মাতৃজঠর থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় বিধায় মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক একেবারে নাড়ির। যা অচ্ছেদ্য যাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন করা মা আর সন্তান কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কোন মাতৃক্রোড়ে তার সন্তান মায়ের আজন্ম লালিত স্বপ্নের বিমূর্ত রূপ। আশৈশব দেখা এই মাতৃমঙ্গলের চিরায়ত বৈভব প্রতিটি মায়ের নিজস্ব অন্তর নিঃসৃত সম্ভার। যা পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে যে কোন মেয়ের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ছিলি আমার পুতুল খেলায় প্রভাতের শিব পূজার বেলায় তোকে আমি গড়েছি আর ভেঙ্গেছি। সেই স্বপ্ন বাস্তবের মূর্ত প্রকাশের মধ্য দিয়ে মাতৃত্বের শুভযাত্রা শুরু হয়। দশ মাস দশ দিন গর্ভে লালন করে যখন সেই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে সে কিরণ সত্যিকার অর্থে বিচ্ছুরিত হয় মায়ের সামগ্রিক অবয়বে। মা নিজেকে তৈরি করতে থাকে সন্তানকে বড় করার তাগিদে। মায়ের মমতায় সন্তানকে গড়ে তোলার যে অনবদ্য মহিমা সেখানে একজন মা জীবন তৈরি করার ব্যাপারে সুদক্ষ কারিগরও বটে। এভাবে সন্তানের শৈশব আর বাল্যকাল অতিক্রান্ত করা যেমন মায়ের জন্য একইভাবে সন্তানের জীবনেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পারিবারিক শুদ্ধতার নির্মল আবহে সন্তানের বেড়ে ওঠা এক প্রয়োজনীয় পর্যায়। একটি সন্তান বড় হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা যতখানি সমাজের ভূমিকাও তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কারণ কোন মানুষ যেমন ব্যক্তিক একইভাবে সে সামাজিকও জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর অগ্রসরমান সমাজ সন্তানের মানসিক উৎকর্ষের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। যা সমাজের একজন সুস্থ নাগরিক হিসেবে সন্তানকে গড়ে উঠতে নানা মাত্রিকে সময়োপযোগী ভূমিকা রাখবে এই কথা বলা খুবই সঙ্গত। কিন্তু বিপরীত দিকে সমাজের অসঙ্গতি, বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, অপশক্তি যখন সুস্থ জীবনযাত্রার প্রতিবন্ধক হিসেবে সামনে চলে আসে তখন সন্তানের সাবলীলভাবে গড়ে ওঠাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান যা ভাল-মন্দের বোধ থাকে না ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক বোঝে না, অস্থিতিশীল সমাজের নেতিবাচক প্রক্রিয়াগুলো নানামাতৃকে প্রলুব্ধ করে ঠিক তখনই প্রয়োজন পড়ে একজন সন্তানের সঠিক পথনির্দেশনা। আর এর দায়ভাগ গিয়ে বর্তায় মায়ের ওপর। বাবা-মা দু’জনেরই সন্তান মানুষ করার দায়-দায়িত্ব সমান। কিন্তু প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মা যেহেতু ঘরেই থাকেন আর বাবাকে সময় দিতে হয় কর্মক্ষেত্রে সেহেতু সন্তানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মাকেই সদা জাগ্রত অবস্থায় থাকতে হয়। শুধু সমাজের নিয়মের কারণেই নয়, মা নিজেও মনে করেন সন্তানকে ভালভাবে মানুষ করতে গেলে তার বিকল্প অন্য কিছুু নেই। কিন্তু বর্তমানে অনেক মাই ঘরের সীমানা পেরিয়ে বাইরের জগতেও তাদের কর্মযোগ বিস্তার করেছে। সুতরাং তাকেও একটি বিশেষ সময়ে কর্মক্ষেত্রে থাকতে হয়। তাহলে সন্তানের ভার কার ওপর অর্পণ করা হবে? এসব বিবেচনায় আধুনিক কর্মজীবী মায়েরাও সন্তান বড় করার ক্ষেত্রে হরেক রকমের অসুবিধায় পড়ছে। তার পরেও সন্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ১৩ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত অভিভাবকের দায়িত্ব হয় অনেক বেশি তাৎপর্যবহ। প্রয়োজনীয় সময় দেয়া থেকে শুরু করে সন্তানের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের নির্ণায়ক পর্যায়কে খুব ঠা-া এবং যৌক্তিকভাবে বিবেচনায় এনে সেভাবেই নিজেদের ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তকে কাজে লাগাতে হয়। বয়ঃসন্ধিকালের বয়স বলতে চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীরা যা বলে থাকেন তা হলো কালের ক্রান্তিলগ্ন থেকে শুরু হয়ে উদ্দীপ্ত যৌবনের স্বর্ণশিখরের দ্বার স্পর্শ করা পর্যন্ত। এই স্বল্পকালীন অস্থিরতার সময় কতটুকু প্রত্যেক বয়ঃসন্ধিকালের সন্তানদের নানামাতৃকে আন্দোলিত, বিমোহিত এমনকি বিপর্যয়েরও মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। এ শুধু চিকিৎসক কিংবা মনোবিজ্ঞানীদের কথা নয়, বরং সৃজনশীল ব্যক্তিত্বদেরও এই ১৮ বছর সময়ের অনুভব-অনুভূতি একেবারে অন্য রকম। মহাকবি গ্যাটে তো বলেই ফেললেন তাঁর বয়স যখন আঠারো সে সময় পুরো জার্মানিকে মনে হতো ১৮ বছরের উদ্দীপ্ত তরুণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও একই সুরে সুর মেলান। এই বয়সটা আসলে চমকপ্রদ, অভিনব এবং স্বপ্নে বিভোর হওয়ার এক অভাবনীয় মনন স্বর্গ। আর বিপ্লবী কবি সুকান্ত তো এই উদীয়মান কৈশোরের তারুণ্যকে নিয়ে লিখেই ফেললেন উদ্দীপ্ত করার এক মনোমুগ্ধকর কবিতা। পারিবারিক সুস্থ আর শুদ্ধ পরিবেশ সন্তানের মানসিক বিকাশে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাবা-মার সুসম্পর্ক, পারিবারিক স্নিগ্ধতা, বহির্জগতের প্রতিকূল পরিবেশ থেকে সম্ভাব্য সুরক্ষা সব মিলিয়ে সন্তানের ওপর রাখতে হবে সস্নেহ আর সযত্ন নজরের সার্বক্ষণিক পরিচর্যা। শারীরিক আর মনোজগতের অস্থিরতার সময়গুলোতে সন্তানকে যথার্থ পথনির্দেশনা দেয়া প্রত্যেক বাবা-মায়ের অবশ্য পালনীয় দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যে সময়টা শৈশব আর বাল্যকালের পর্যায় থেকেও সঙ্কটাপন্ন এবং বিব্রতকর। মোহময় দৃষ্টিতে সবকিছুকেই মনে হয় সুন্দর আর মুগ্ধতার আবেশে আচ্ছন্ন। আবার কোন কিছুতেই ভাল না লাগার বিপত্তিও ঘটতে পারে সময়ে-অসময়ে। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়বোধ কিসের তাড়নায় যেন হরেক রকম ঘূর্ণাবর্তে পাক খায়। অতি নিকটজনের সান্নিধ্য কখনও আনন্দাবেগে আপ্লুত হয় নয়তবা নতুনত্বের সন্ধানে সে সম্পর্কের বাঁধন আগলা হতেও সময় নেয় না। যথাযর্থ অভিভাবকের ভূমিকায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রত্যেক বাবা-মাকে সন্তানের এই অনিয়ন্ত্রিত মুহূর্তগুলোকে সামাল দিতে পারাটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জের পর্যায়ে চলে যায়। আর আর্থ-সামজিক প্রতিবেশ যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয় তাহলে সন্তানের মানসিক চাপ নানামাতৃকে বাড়তে থাকে। সুতরাং সুস্থ সমাজ ও সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের অন্যতম নির্ণয়াক শক্তি। পারিবারিক শুদ্ধতা সন্তানের সুস্থ মানসিক গড়নকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় সামাজিক অস্থিরতায় তা আবার পশ্চাদগামী হতেও সময় লাগে না। আর সেখানেই বাবা-মাকে নামতে হয় সামগ্রিক মঙ্গলের বার্তা নিয়ে। যে বাণী সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করবে, সন্তানের সার্বিক সুরক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। সব থেকে বেশি জরুরী সন্তানের সুস্থ মনোজাগতিক চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে সুষ্ঠু এবং স্বাভাবিক মাত্রায় সেটাকে তার কাছে পৌঁছে দেয়া। বিভ্রান্ত এবং বিড়ম্বিত জীবনের মোহপাশ থেকেও সন্তানকে বাঁচাতে হবে। ঠান্ডা মাথায়, স্থির চিত্তে সন্তানের পক্ষে যা যা শুভ আর মঙ্গল তা প্রয়োগের মাধ্যমে অশুভ সঙ্কেতের সমস্ত বন্ধনজাল ছিন্ন করে দিতে হবে। প্রয়োজনে স্নেসিক্ত ধারায় কঠোর আর কঠিন হয়ে সন্তানের ভবিষ্যত কর্মপন্থা এবং চলার পথ নিশ্চিত, নিরাপদ আর নির্বিঘ্ন করতে হবে। এই ক্রান্তিকালীন সময়টা পার করতে যেমন সন্তান একইভাবে বাবা-মাকেও বিশেষ সতর্ক আর সাবধানতার এই অনভিপ্রেত পর্যায়কে অতিক্রম করতে হবে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×