ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের মুখপ্রিয় নগরপিতা

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বপ্নের মুখপ্রিয় নগরপিতা

ফেসবুকের পাতায় পাতায় আনিসুল হকের ছবি। হাসিমাখা মুখ। ছোট-বড় ভিডিও। একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী লাকি আখন্দ গাইছেন তাঁর বিখ্যাত সেই গান ‘আমায় ডেকো না... ফেরানো যাবে না ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না’, আর আমাদের প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, গভীর মনোযোগ দিয়ে গানটি শুনছেন আর অসুস্থ শিল্পী লাকি আখন্দের শরীরে গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আনিসুল হক একজন দয়ার্দ্র মানুষ, তাঁর অন্তর জুড়ে মানুষের জন্য অসীম ভালবাসা ও মমত্ব আর তাই হয়ত তাঁর অকাল প্রয়াণে কেঁদেছে অসংখ্য বাংলাদেশী, শোকের মাতম উঠেছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। আনিসুল হকের কথা বললেই সবার চোখে প্রথমে ভেসে ওঠে একজন সুদর্শন তরুণের মুখ যিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে নব্বই দশকে একটি ব্যতিক্রমী গানের অনুষ্ঠান নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হন। অনুষ্ঠানটির নাম ‘জলসা’। এই অনুষ্ঠানে আনিসুল হক একটা অভাবনীয় কাজ করলেন। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দুটি সঙ্গীতধারাকে এক মঞ্চে আনলেন এবং একদলকে দিয়ে অন্যদলের পছন্দনীয় গান করালেন। যেমন তাঁর সেই অনুষ্ঠানের শুরু হলো ব্যান্ড দল রেনেসার কণ্ঠশিল্পী নকীব খানের গাওয়া একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। নকীব খান গাইলেন ‘ভালবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে, আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জিরে।’ এরপর নজরুল সঙ্গীত শিল্পী সাদিয়া আফরীন মল্লিক গাইলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল মাইলসের একটি গান। এই যে মানুষের মধ্যে বিরাজমান ভিন্নতা, চেতনার সচেতন বহির্প্রকাশ, বৈচিত্র্যের মাঝেই উপস্থিত মধুর সুর– সেই সুর তুলে আনতে পারে কয়জন? আনিসুল হক পেরেছিলেন, তিনি বুঝেছিলেন মানুষের সুকুমারবৃত্তি তার অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যাবেলার চাইতে অনেক পরিস্ফুট আর সেইজন্যই বোধহয় বাংলাদেশের মানুষ খুব অল্পসময়ে ঢাকার এই পরিচিত প্রিয় মুখটিকে ঢাকা উত্তরের নগরপিতা হিসেবে প্রাণপ্রিয় করে নিয়েছিল। আনিসুল হক তখনও মেয়র হননি, কর্মসূত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থীগণের কাছে নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাবাসীর অধিকার অন্তর্ভুক্তির অনুরোধ নিয়ে যাবার সুযোগ হয়েছিল এই প্রতিবেদক ও তার সহকর্মীদের। আমরা চেয়েছিলাম আনিসুল হকের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকবে ঢাকাবাসীর জন্য নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব পাবলিক টয়লেট স্থাপনের প্রতিশ্রুতি। আনিসুল হক এই আবেদনে সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন নির্বাচিত হলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সমমনা সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাবলিক টয়লেট প্রতিস্থাপনের কাজ করবেন। নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করলেন এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। তাঁর ৩০ মাসের মেয়র থাকাকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইড ও সমমনা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এমন কিছু পাবলিক টয়লেট নির্মিত হয়েছে যা বিশ্বমানের, নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ এবং সকলের জন্য অভিগম্য। নগরপিতা হিসেবে তারপর তিনি আরও অসাধারণ কাজ করেছেন যা ঢাকাবাসীর জন্য অভাবনীয়ই বলতে হয়। আনিসুল হক একজন অসামান্য গুণী ব্যক্তি ছিলেন। একাধারে তিনি টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, সফল ব্যবসায়ী, অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা, বহুমুখী উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, সামাজিক ও ব্যবসায়িক নানা ব্যতিক্রমী উদ্যোগের সংগঠক। যদিও তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন বেশ দেরি করেই, কিন্তু ২০১৫ সালের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে তিনি বিজিএমই এবং এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে তিনি একটি ব্যতিক্রমী বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যেখানে বাংলাদেশের শীর্ষ দুটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি বসানোর ব্যবস্থা করা হয়, কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়। এক সময় তিনি সার্ক চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে বেসরকারী খাতে বিদ্যুত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএরও সভাপতি ছিলেন। মেয়র আনিসুল হকের একটি বড় গুণ হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সকল দলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারতেন, তাঁর বিরল ব্যক্তিত্বের গুণে রাজনৈতিক বিরোধ স্বল্পসময়ের জন্য হলেও সরিয়ে রেখে সংলাপে বসতেন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। মেয়র থাকাকালীন আনিসুল হক সফলভাবে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তা, গাবতলী বাস টার্মিনাল, গুলশানের মরিয়ম টাওয়ারের পেছনের রাস্তা, মোনায়েম খানের বাড়ির সামনের রাস্তা, বিভিন্ন দূতাবাসের সামনের রাস্তা দখলমুক্ত করেছেন। তাঁর কাজের সফলতার একটি বড় কারণ হচ্ছে তিনি এইসব কাজ বাস্তবায়নের সময় সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে বসেছেন, বুঝিয়েছেন, তারপর কাজে নেমেছেন। গুলশানের রাস্তাঘাট অনেকাংশেই দখলদারমুক্ত করেছেন, ফুটপাথ প্রশস্ত করেছেন, অবৈধ কারপার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। ই-টেন্ডার ব্যবস্থা জোরদার করেছেন, এ কারণে অনেকসময় বড় বড় ব্যবসায়ীদের রোশানলেও পড়েছেন, কিন্তু পিছিয়ে যাননি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৬৩টি জায়গায় রাস্তার ওপর ময়লার কনটেইনার থাকত, মেয়র আনিসুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জায়গা নিয়ে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) করেছেন। এখন সড়ক থেকে ময়লার কনটেইনার সরেছে। মশা নিয়ে শহরবাসীর অনেক অভিযোগ ছিল। ভোটাররা মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ভূমিকায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। মেয়র আনিসুল হক এ বিষয়ে তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন তাঁর দায়িত্ব নেবার প্রথম বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি মশার ওষুধ দেওয়া হয়েছে পরবর্তী বছরগুলোতে, মশা নিয়ন্ত্রণে বাজেট বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে তিনগুণ, কিন্তু তবুও মশা কমেনি। মেয়র আনিসুল হক এমন একটি শহরকে প্রাণবন্ত, সবুজ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন যেখানে আমরা অর্ধ-কোটি টাকার গাড়ির কালো কাঁচ খুলে নির্বিচারে চিপস, চকোলেটের প্যাকেট ফেলে দিই রাস্তায়, রান্না ঘরের জানালা দিয়ে নির্বিকারে ময়লা ফেলি নিচের ড্রেনে। অথচ বৃষ্টির দিনে সেই আবর্জনায় ঢাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়লে দোষ দিই মেয়রের, কাউন্সিলরদের। পৃথিবীতে এমন আর কোন শহর কি আছে যেখানে নাগরিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব? এমন কোন শহর আছে যেখানে গাড়ি বাড়ির মালিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ব্যতিরেকে যানজট কমানো সম্ভব? আমি এমন এক ভদ্রলোকের কথা জানি যিনি প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা বাজেট রাখেন গাড়ির সিটবেল্ট না বেঁধে জরিমানা দেওয়ার জন্য। এই শহরে স্কুল কলেজের সামনে অভিভাবকরা সন্তানদের গাড়ি থেকে নামানোর সময় মূল রাস্তা আটকে রাখেন, বিয়ে গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানে রাস্তা চলে যায় ব্যক্তি দখলে, আবার সেই আমরাই বৃষ্টি হলে, জ্যাম হলে মেয়রকে গালি দিই, জলাবদ্ধতার জন্য নিজের দায়বদ্ধতার জায়গাটা ভুলে যাই বেমালুম ভাবলেশহীনতায়! মেয়র আনিসুল হক তবু আশা ছাড়েননি। এলাকায় এলাকায় গণসংযোগ করেছেন, মানুষের কাছে গিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন, সচেতন করেছেন। অন্যায়কারী, চাঁদাবাজ, দখলদারদের কঠোর হস্তে দমন করেছেন। মধ্যরাতে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে বিপর্যস্ত পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, দমকল বাহিনীর সঙ্গে নেমে পড়েছেন আগুন নেভানোর কাজে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নগরপিতা একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন প্রিয় নগরবাসীর জন্য। রাজধানীবাসীর জন্য হাঁটাচলার ব্যবস্থা করা, সড়ক বাতির ব্যবস্থা করা, রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। ঢাকা শহরের যানজট লাঘব করার জন্য চার হাজার বাস নামানোর কাজ সিটি করপোরেশনের না হলেও তিনি সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাসমালিক, সুবিধাভোগীদের কয়েকটি রুটে একই বাস নামাতে রাজি করিয়ে ছিলেন। গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন সোসাইটির সহায়তায় সিসি ক্যামেরা বসানো, নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ ও গেট বসিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ইকবাল হাবিব, কাসেফ মাহবুব চৌধুরী, মুস্তাফা খালিদ পলাশ, এনামুল করিম নির্ঝরদের নিয়ে তিলোত্তমা ঢাকা বানানোর কাজে পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন। আনিসুল হকের মেয়র নির্বাচনটা বেশ নাটকীয় ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধেই তিনি নির্বাচন করতে রাজি হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই নিজের দলের বাইরে গিয়ে দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে যাদের ভাল মনে করেছেন তাদের নির্বাচনে উৎসাহিত করেছেন। সেই নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আনিসুল হক মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হবার পরের একটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছিলেন পরবর্তীতে। গুলশান, বনানী, বারিধারার কিছু পরিচিত ও প্রভাবশালী দখলদারদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে কী করবেন জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন দখলদারীরা তাঁর কেউ নন। তিনি সাধারণ মানুষের প্রধানমন্ত্রী। আনিসুল হক নানা সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা এবং আপোসহীনতাকেই তাঁর অনমনীয় অবস্থানের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আনিসুল হক খুব দুর্দান্ত ছাত্র ছিলেন এমন নয়। এসএসসির একটি পরীক্ষায় ৩৪ পেয়ে পাস করবার পিছনে তাঁর মায়ের দোয়াকে তিনি সবচেয়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখেছেন বলে জানিয়েছিলেন। কোন বিপদে পড়লেই তিনি তাঁর মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে পড়তেন, দোয়া চাইতেন। পরীক্ষার হলে তাঁর মা তাকে নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন। আনিসুল হক পরীক্ষায় যখন মাত্র ৩৪ উত্তর দিয়ে বাইরে আসলেন, তখন তাঁর মা জানতে চাইলেন, পাস নম্বর কত? আনিসুল হক বললেন ৩৩। তখন তাঁর মা পরীক্ষার হলের সামনেই নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যান এবং সেই পরীক্ষায় আনিসুল হক ৩৪ এ ৩৪ পেয়ে পাস করেন। প্রধানমন্ত্রী যখন তাকে মেয়র প্রার্থী হতে বলেন, তখন তিনি পরামর্শের জন্য তাঁর বাবার কাছে গিয়েছিলেন। ততদিনে তাঁর মা গত হয়েছেন। আনিসুল হকের বাবা তাকে বলেন, তুমি তোমার মায়ের কাছে যাও। আনিসুল হক বলেন, মা তো মরে গিয়েছেন, তিনি কিভাবে পরামর্শ দেবেন? আনিসুল হকের বাবা হাসতে হাসতে বলেন, কবর থেকেই ফুঁ দেবেন। আনিসুল হক ছিলেন একজন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি। আশির দশকে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তরুণদের কাছে তাঁর তুলুম জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে তৎকালীন সামরিক শাসক তাকে তুলে নিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টেলিভিশনের মাধ্যমে সামরিক শাসকবিরোধী আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে অনুষ্ঠান করবার জন্য। আনিসুল হক সেখান থেকে চলে আসেন, যেখানে ফজলে লোহানীর মতো জনপ্রিয় উপস্থাপকরা সেই সামরিক শাসকের হুমকি অগ্রাহ্য করতে পারেননি। নগরপিতার দৃঢ় চরিত্রের বড় নিদর্শন আমরা দেখেছি তেজগাঁয়ের ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তা উচ্ছেদের সময়। শ্রমিক নেতারা তাঁকে ঘেরাও করেছে, তাঁর কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করেছে, তাকে জিম্মি করে এই কাজ থেকে বিরত রাখতে চেয়েছে। তিনি অবিচল থেকেছেন। আলোচনার চেষ্টা করেছেন, শেষে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে তেজগাঁয়ের ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তা দখলমুক্ত করেছেন। এটি যে একটি রাস্তা এবং এখান দিয়ে গাড়ি চলাচল করতে পারে সেটি গত কয়েক দশকে ঢাকাবাসী ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। আনিসুল হকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘ঢাকাবাসী জানে, হাজারো সমস্যার সমাধান অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। একটি সংস্থার মালিকানা ও তদারকিতে থাকা সত্ত্বেও খাল কিভাবে ভরাট হয়ে সুরম্য অট্টালিকায় পূর্ণ হয়ে গেল তার জবাব কোথাও নেই। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও তদারকির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কী করে ঢাকার সরু গলিতে বহুতল ভবন হলো- তার উত্তর কাউকে দিতে হয় না। এসব কারণে মেয়র আনিসুল হককে বাস্তবের জগত থেকে সরিয়ে মানুষকে স্বপ্নের মায়াময় জগতে নিয়ে যেতে হয়েছে।’ আসলেই তো মেয়র আনিসুল হক এমন একটি শহরের দায়িত্ব নেবার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন যেখানে রাস্তাগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। গাড়ি ঢুকলেও পানির অভাবে বালতি নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয় দমকল কর্মীদের। শহরের দম বন্ধ করা রাস্তায় মৃতপ্রায় রোগীদের বুকে নিয়ে থমকে থাকে এ্যাম্বুলেন্স, কেউ সরে দাঁড়ায় না, হয়ত সরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে না বলে। এই শহরের রাস্তায় যে কোন সময় যে কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করে বিশাল ব্যানার বসাতে পারে, ফুটপাথে খুলতে পারে খাবার দোকান। খাবার পানির লাইনে ভেসে আসে নর্দমার কীট, সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে নৌকা চলে, পার্কগুলো থাকে ভাসমান পতিতার দখলে, খাল দখল হয় সুউচ্চ ভবন নির্মাণে, বিশ বছরের পুরনো বাতিল যানবাহনে ভর্তি তিলোত্তমা নগরী, যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং আর বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা আমাদের নিত্যদিনের নিয়তি। এই শহরে মানুষ দামী রেস্তোরাঁয় একবেলা খাবারের পেছনে হাজার টাকা খরচ করে, কিন্তু টিআইএন নম্বর খোলে না ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য। এ শহরের আমরাই বাচ্চাকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে স্কুলে ভর্তি করাই কিন্তু বিদ্যুতের বিল ফাঁকি দেবার জন্য নিই লাইনম্যানের অন্যায় সাহায্য। এমনই একটা শহরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রাণের মানুষ আনিসুল হক। আসলে কি দায়িত্ব নিয়েছিলেন না দায়? ঢাকা শহরের এলোমেলো মানুষগুলো যখন আবার তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, ধোঁয়াটে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছিল আশাবাদী সূর্য, ঠিক তখনই নগরপিতা হারিয়ে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে। এই শহরকে বহু আগে অভিশাপমুক্ত করতে চেয়েছিলেন মেয়র হানিফ। সেই সময়ে আমরা দেখেছি সারারাত জেগে পরিচ্ছনতাকর্মীদের সকালের সূর্য উঠবার আগে একটি পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দেয়ার প্রয়াস। সেই শহরই আবার প্রায় দুই যুগ পরে জেগে উঠতে শুরু করেছিল প্রিয় মানুষ আনিসুল হকের হাত ধরে। কিন্তু বড্ড অসময়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু নিয়েও ছিল নানা গুজব, বার বার বিদেশের মাটিতে হাসপাতালের দরজায় গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন আবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। ঢাকাবাসীর ভালবাসাই কি তবে তাকে এতদিন আটকে রেখেছিল পৃথিবীর মায়ায়? কে জানে! প্রিয় মেয়র, নগরপিতাকে ঢাকার মাটিতে মৃত্যু কেড়ে নিতে পারেনি। তাই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন দূরদেশের মাটিতে। যখন দেশের মাটিতে ফিরলেন তখন প্রিয় শহরবাসীর চোখে কেবলই প্রিয়জন হারানোর বেদনা, বিদায়ী অশ্রু। তিনি এমনই একজন মানুষ যার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা একঘণ্টা বেশি কাজ করেছেন একদিন। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ক্যানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাতের ফেসবুক পেইজে গেলেই ভেসে আসে আনিসুল হকের বহু গভীরে হারিয়ে যাওয়া একটা বিষাদময় ছবি, যার সঙ্গে স্ট্যাটাস হিসেবে লেখা আছে ‘এ শহরের কোনায় কোনায় আনিস ভাইয়ের স্মৃতি। এখনও মানতে পারছি না, তিনি নেই। ভাবতে পারছি না তিনি আর কখনোই ফিরে আসবেন না।’ প্রিয় নগরপিতা, আপনি আর ফিরে আসবেন না জানি, কিন্তু একটি স্বপ্নবিমুখ জাতিকে আবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আপনি, এই শহর নিশ্চয় আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। আনিসুল হক বাংলাদেশের একটি প্রিয় প্রেমের নাম, অপ্রিয় বিচ্ছেদের নাম হয়েই থাকবেন। আমরা জানি বাংলাদেশ কখনও হারেনি, বিজয়ের মাসে প্রিয় বাংলাদেশ নিশ্চয় আপনার হাসিকে হৃদয়ে ধারণ করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে হেঁটে যাবে। [email protected]
×