ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড প্রাঙ্গণ

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড প্রাঙ্গণ

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবন যাত্রার মান বদলে দিয়েছে। প্রতিদিনের কর্মকান্ডে আমরা কোন না কোনভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। দেশে নতুন নতুন এ্যাপ তৈরি হচ্ছে। যেগুলোর মাধ্যমে আমরা সহজেই যেকোন সমস্যার সমাধান পেয়ে যাচ্ছি। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জানার শেষ নেই।’ আইসিটির প্রতি ভালবাসা থেকেই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে জ্ঞান অর্জনের জন্য এসেছেন কলেজ শিক্ষার্থী তাহমিনা তাবাসসুম। শুধু তাহমিনা নয় বৃহস্পতিবার ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৭’ প্রাঙ্গণ তার মত অনেক শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উৎসব ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড। শুধু বই খাতায় নয়, এর বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তির যে বিশাল বিস্তৃতি আছে তা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের উদ্বোধনী দিন থেকেই রাজধানী বিভিন্ন স্কুল থেকে কৌতূহলী শিক্ষার্থীরা ভিড় জমাচ্ছেন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে। অনেকেই আবার তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ের উপর দিনভর চলমান ভিন্ন ভিন্ন সেমিনারে যোগদান করে সেসব বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় দিনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের ৪০-৫০ জনের একটি করে টিম এসেছিল ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড প্রাঙ্গণে। তাদের পদচারণায় তথ্য ও প্রযুক্তি উৎসবটি যেন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক থেকে এসেছে ৪০ জনের শিক্ষার্থীর একটি টিম। তাদের মধ্যে আছে নুসরাত জাহান, শারমিন আক্তার, মনিরা আক্তার। নুসরাত জাহান বলেন, আগামীর ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালভাবে জানতে আমরা মেলায় এসেছি। দেশে নতুন নতুন এ্যাপ তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন এ্যাপের সাহায্যে অনেক বড় সমস্যাও এখন সমাধান করা সম্ভব। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে এলে এসব বিষয়ে ব্যাপক ধারণা পাওয়া যায় তাই আজ আমরা সবাই মিলে এসেছি। ‘আগামীর জন্য প্রস্তুত-রেডি ফর টুমরো’ এই স্লোগান নিয়ে ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড চলবে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার (বিআইসিসি) পঞ্চম বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৭। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে সরকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নের হার শত ভাগের উর্ধে অর্থাৎ ১২১ শতাংশ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের নানা প্রকল্প ও কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ভাষা প্রশিক্ষণ ॥ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৫ হাজারের বেশি কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে, যার মধ্যে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব’ অন্যতম। দেশের ২০০১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাবের মধ্যে ৬৪ জেলায় একটি করে ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব ল্যাবে ৯টি বিদেশী ভাষা শেখানো হবে। এছাড়া আরও ৮শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও ১০০টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপনের সমস্ত প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। ইনোভেশন ডিজাইন এ্যান্ড এন্টারপ্রেউনারশিপ একাডেমি ॥ তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবন, সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যোক্তাদের সিডি ফান্ড ও ভেঞ্চর ক্যাপিটাল প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদান এবং গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা সৃষ্টির জন্য ইনোভেশন ডিজাইন এ্যান্ড এন্টারপ্রেউনারশিপ একাডেমি (আইডিয়া) প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর একনেক প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২২৯ দশমিক ৭৪ কোটি টাকা। স্টার্টআপ, প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা, গবেষক, সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়িক নেতা, পরামর্শক, ছাত্রসহ অন্যদের একই ছাদের নিচে আনার লক্ষে আইডিয়া প্রকল্পটি কাজ করবে। শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার ॥ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ আইটি খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে দেশের ৭টি স্থানে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্থানগুলো হচ্ছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, চট্টগ্রাম বন্দর, নাটোরের সিংড়া, কুমিল্লা সদর, নেত্রকোনা সদর, বরিশাল সদর ও মাগুরা সদর। নাটোরের শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে একসঙ্গে ৪৮০ জন ট্রেনিং করতে পারবে। এছাড়া ৫০টি স্টার্টআপ, ২৯টি প্লাগ এ্যান্ড প্লে গড়ে উঠবে। চুয়েট আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর ॥ আইটি খাতে দক্ষ মানবসম্পদ ও উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি বিজনেস এ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পের পিইসি সম্পন্ন করার পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জনবল অনুমোদিতও হয়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলায় প্রশিক্ষণ ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে একুশ শতকের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে দেশের আইটি পেশাজীবীর সংখ্যা ২০ লাখে উন্নিত করা। এ লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে আইটি প্রশিক্ষণ, বিশেষায়িত ল্যাব এবং আইটি প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য সচেতনমূলক ইভেন্টের আয়োজনও থাকবে। ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল টেক্সট বুক ॥ পাঠ্য বিষয়বস্তুকে আনন্দদায়ক করে উপস্থাপনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ের ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল কনটেন্ট প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ২১টি টেক্সটবুক বা ই-বুক রুপান্তর করে বিভিন্ন স্কুলে বিতরণ করা হয়েছে। গতবছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিজিটাল টেক্সটবুক উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত ডাউনলোড হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার। আইসিটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প ॥ আইটিতে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে এলআইসিটি প্রকল্প উদ্যোগের দেশের ৬৪ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজে আইসিটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। এ পর্যন্ত ৩৬টি জেলায় আইসিটি ক্যারিয়ার ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। এসব ক্যাম্প আয়োজনের মাধ্যমে ৭০ হাজার ছাত্রছাত্রীকে অনলাইনে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ বছরের মার্চের মধ্যে বাকি জেলাগুলোতে এ ক্যাম্পের আয়োজন করা হবে। মোবাইল গেম ও এ্যাপ্লিশন তৈরির প্রশিক্ষণ ॥ বিশ্বব্যাপী মোবাইল গেমের বিশাল বাজার রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত বিভিন্ন দেশ মোবাইল বাজার থেকে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশ এ বাজারে প্রবেশ করতে চায়। এজন্য মোবাইল গেম ও এ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। বিশেষায়িত ল্যাব ॥ তথ্য প্রযুক্তিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে বিগ ডাটা এ্যানালাইটিকস বিষয়ে বিসিসিতে ইতোমধ্যে একটি টাইটানিয়াম ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিসিসির এলআইসিটি ও ইনফোরকার-২ প্রকল্পের আওতায় যথাক্রমে একটি বিশেষায়িত ল্যাব এবং স্পেশাল সাউন্ড ইফেক্ট ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ ল্যাবগুলোতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আইটিতে দক্ষ করে তোলার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়ার টেস্টিং ল্যাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এ্যানিমেশন ল্যাব এবং বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রোবটিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ডেটা সফটের সঙ্গে একটি ইন্টারনেট অব থিংক (আইওটি) ল্যাবও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ ॥ এক্সিম ব্যাংকের সহযোগিতায় ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ প্রোগ্রামের আওতায় মেধাবী ও অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের নেতৃত্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এগিয়ে যাওয়ার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি জুনাইদ আহমেদ পলক তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম এবং আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। সরকারের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে আগত একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, তরুণ প্রজন্ম দেশ ও জাতির ভবিষ্যত। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দেশের শিক্ষিত তরুণ তরুণীকে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেসব দিক বিবেচনা করে তরুণ প্রজন্মকে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ করতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা অবশ্যই একটা কার্যকরী পদক্ষেপ।
×