ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সারাদেশে তুলা চাষে ধীরগতি

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সারাদেশে তুলা চাষে ধীরগতি

সমুদ্র হক ॥ ঐতিহ্যের মসলিন কাপড়ের এই দেশে তুলা চাষ হচ্ছে ধীর গতিতে। দেশে সমতল ও পাহাড়ী উভয় ভূমি কার্পাসের আঁঁশ তুলা চাষের উপযোগী। ব্রিটিশ পর্যটক জন টেলরের মতে, দূরাতীত অষ্টাদশ শতাব্দে ঢাকার সোনারগাঁও, রংপুর, বগুড়া অঞ্চলে প্রচুর তুলা চাষ হতো। কালের সেই সাক্ষী আর ধরে রাখা যায়নি। দেশে তুলার চাহিদা বছরে অন্তত ৫০ লাখ বেল। উৎপাদিত হয় প্রায় ২ লাখ বেল। বাকি তুলা আমদানিনির্ভর। আমদানিতে বিনিয়োগ করতে হয় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছর (২০১৭-১৮) তুলা উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ৬০ হাজার হেক্টরে চাষ হয়ে উৎপাদিত হবে ২ লাখ ৪২ হাজার বেল। এর মধ্যে সমতলভূমির ৩৩ হাজার হেক্টরে তুলা চাষ হয়ে উৎপাদন হওয়ার কথা ২ লাখ ১৭ হাজার ৭শ’ বেল। পাহাড়ী ভূমির ২৭ হাজার হেক্টরে উৎপাদিত হওয়ার কথা ২৪ হাজার ৩শ’ বেল। ষাটের দশকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকরা বাংলাদেশে তুলার আবাদ করতে দেয়নি। ১৯৭১ সালে দেশ মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালে তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তুলা উন্নয়ন বোর্ড (তুউবো) গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে তুউবো মাঠপর্যায়ে আমেরিকান আপল্যান্ড তুলা দিয়ে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে। এরপর নতুন জাত প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যাপক তুলা চাষ শুরু হয়। ’৯০-এর দশকে তুলা গবেষণার দায়িত্ব বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে তুউবোর নিকট হস্তান্তর করা হয়। ঢাকা, যশোর, রংপুর ও চট্টগ্রামে চারটি আঞ্চলিক অফিসের আওতায় ১৩টি জোন অফিস, ৩৯টি জেলা অফিস ও ১শ’ ৯৫টি ইউনিয়ন ইউনিটের মাধ্যমে তুলা চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। আঞ্চলিক অফিস রয়েছে ঢাকা, যশোর, রংপুর ও চট্টগ্রাম। জোন অফিসগুলো ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি। বগুড়া জোনের আওতায় বগুড়াসহ ৫ জেলা ও ১৪টি ইউনিট রয়েছে। বাকি জেলাগুলো হলো- জয়পুরহাট, নওগাঁ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ। ইউনিট অফিস রয়েছে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার সুখানপুকুর, ধুনট, শিবগঞ্জ ও সারিয়াকান্দি উপজেলা। সরকারী নিয়মানুযায়ী তুউবো’র ম্যান্ডেট হলো: তুলা চাষের ব্যাপ্তি সাধন, কৃষি উপকরণ উন্নত বীজ সার সরবরাহ, উদ্ভিদ সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেয়া। তুলাচাষীদের প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রদর্শনী খামার স্থাপন। তুলা বাজারজাতকরণে সহায়তা দেয়া। বগুড়ার মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা যায়, যে হারে তুলা চাষ হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। কৃষকরা তুউবোর বগুড়া জোন অফিসের কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা পান না। একটা সময় বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায় ব্যাপক তুলার চাষ হতো। বর্তমানে ওই এলাকার কৃষক তুলা চাষবিমুখ হয়েছেন। ক’জন তুলাচাষী জানান, আগে তুলার চাষ করতেন। তুলার আবাদে বেশি পোকা লাগে। পোকা দমনে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। তুলা উৎপাদনের পর বাজারজাতকরণে সমস্যা দেখা দেয়। যে কারণে তারা তুলা আবাদবিমুখ হয়েছেন। এই বিষয়ে জানার জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড বগুড়া জোন অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা প্রথমে এক সপ্তাহ পর যেতে বলেন। রবিবার (৫ নবেম্বর) সকালে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বিকেল তিনটায় জোন অফিসের চীফ কটন ডেভেলপমেন্ট অফিসার মোস্তফা কামালের সঙ্গে তুলা বিষয়ে জানার জন্য সহযোগিতা চাইলে তিনি সহযোগিতা না করে ফের এক সপ্তাহ পর যেতে বলেন। পরে জানা যায়, তুলাচাষীরা এই অফিসে গিয়ে তার কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পান না। তুউবোর আরেক উর্ধতন সূত্র জানায়, প্রতি বছর চারটি তুলা গবেষণা খামারে মৌল ও ভিত্তি বীজ আমেরিকান মানের প্রত্যায়িত বীজ চাষীদের মাধ্যমে উৎপাদন ও স্বল্পমূল্যে বিতরণ করা হয়। তুলা বাজারজাতের জন্য তুউবোর ১২টি জিনিং কেন্দ্র আছে। তারা আঁশ তুলার মানোন্নয়ন ও বাজার মূল্য নির্ধারণ করে। সমতল ভূমির আমেরিকান তুলা ও পাহাড়ী ভূমির তুলা বাজারজাত হয়। দেশে আঁশ তুলার চাহিদা বেশি। বস্ত্র কারখানাগুলো আঁশ তুলা কিনছে। গত ক’ বছরে তুলার কয়েকটি জাত এসেছে। এর মধ্যে সিবি-১৩, ১৪, ১৫ ও হাইব্রিডের একটি জাত মাঠ পর্যায়ে গেছে। সমতলের ভূমিতে প্রতি বিঘায় সাধারণ তুলা উৎপাদিত হয় ১০ মণ করে। হাইব্রিড তুলার উৎপাদন বিঘাপ্রতি ১৬ মণ। শ্রাবণ ও ভাদ্রের মাঝামাঝি তুলা বীজ বপন হয়ে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে তুলা কৃষকের ঘরে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই তুলা সরকারী প্রতিনিধি ও আড়তদার কিনে নেয়। কখনও মাঠ থেকেই ফসল বিক্রি হয়। তবে বগুড়া জোনের আওতায় তুলা উৎপাদনে তেমন সফলতা আসেনি। বর্তমানে পাহাড়ী অঞ্চলে হাইব্রিড কার্পাস তুলা চাষ বেশি হচ্ছে। উল্লেখ্য, পাহাড়ী এলাকার মানুষ আগে তামাক চাষ করতেন। তারা এখন তামাকের আবাদ বাদ দিয়ে তুলা চাষে এগিয়ে এসেছেন।
×