ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সঞ্জয় সরকার

নেত্রকোনায় উদীচী ট্র্যাজিডির এক যুগ

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

নেত্রকোনায় উদীচী ট্র্যাজিডির এক যুগ

৮ ডিসেম্বর ২০০৫। সকাল সাড়ে ৮টা। নেত্রকোনা শহরের অজহর রোডে অবস্থিত সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যালয়ে পাশের ফাঁকা জায়গায় লাল স্কচটেপে মোড়ানো একটি কৌটাসদৃশ বস্তু দেখতে পেয়ে জড়ো হলেন কিছু উৎসুক মানুষ। কৌটার ওপর একটি ভাঁজ করা কাগজ (চিঠি)। ব্যাপারটি বোঝার কিছু বাকি থাকল না কারও। কারণ দেশজুড়ে তখন ‘বোমা আতঙ্ক’। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে বোমার সন্ধান মিলছে। বলা চলে গোটা দেশেই তখন বোমাবাজির সিরিজ উৎসব চালাচ্ছিল ঘৃণ্য, জঘন্য, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী জঙ্গীরা। খবর পেয়ে দমকল কর্মীরা এসে পানি স্প্রে করলেন বোমাটির ওপর। অতঃপর একটি বাঁশ দিয়ে খোঁচা দিতেই সেটি বিস্ফোরিত হলো। এতে সামান্য আহত হলেন পুলিশের এক সদস্যসহ কয়েকজন। এরই মধ্যে বোমার খবর ছড়িয়ে পড়ল শহরজুড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ও পার্শ্ববর্তী শতদল সাংস্কৃতিক একাডেমির সংস্কৃতি কর্মী এবং সাধারণ জনতার ভিড় বাড়তে থাকল উদীচী কার্যালয়ের সামনে। পরদিন ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল উদীচীতে। বিস্ফোরণের কয়েক মিনিটের মধ্যে ছুটে এলেন পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চলে গেলেন। এর পরপরই ঘটল আত্মঘাতী দ্বিতীয় বোমা হামলার মর্মন্তুদ ঘটনাটি। মানুষের জটলার মধ্যেই বাইসাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ল এক কিশোর। আর অমনি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো আরও একটি শক্তিশালী বোমা। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হলো উদীচী, শতদল ও আশপাশের এলাকা। স্পিøন্টারের আঘাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল অসংখ্য মানুষ। রক্তে ভেসে গেল অজহর রোড। সারা শহরে শুরু হলো ছুটোছুটি। হতাহতদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হলো সদর হাসপাতালে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে সেখানেও দেখা দিল আরেক বোমাতঙ্ক। চারদিকে গুজবÑ ‘হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকা আহতদের মধ্যে একজন আত্মঘাতী জঙ্গী। তার শরীরে বোমা’। তার ভয়ে সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, চিকিৎসক-নার্সরাও ভেতরে যাচ্ছেন না। অচল হয়ে পড়ে জরুরী চিকিৎসা কার্যক্রম। আহতরা বারান্দায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাস সময় কাটছে হতাহতদের স্বজন ও উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষের। প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পর একজন বোমা বিশেষজ্ঞ এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, ‘কারও শরীরে বোমা নেই।’ অচলাবস্থার কিছুটা নিরসন হলো। দুপুর থেকে শুরু হলো আরও এক কূটচাল নাটক। ভিন্নখাতে মোড় নিতে শুরু করল ঘটনাটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক সদস্যকে বলতে শোনা গেল ‘বোমা হামলায় আহত হিন্দু যাদব দাস একজন আত্মঘাতী জঙ্গী’। ঘটনার আকস্মিকতায় ঢাকা থেকে নেত্রকোনা হাসপাতালে ছুটে গেলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও গণমাধ্যম কর্মীরা। নিহত যাদবের হিন্দুত্ব প্রমাণের জন্য প্রতিমন্ত্রীর সামনে তার (যাদবের) কাপড় পর্যন্ত টেনে তোলা হলো। মিডিয়া কর্মীরা ক্যামেরা তাক করে ‘নিজ জেলায়’ বোমা হামলার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন প্রতিমন্ত্রীর কাছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট বলে দিলেন ‘ইটস্ এ নিউ ডাইমেনশন ইন জঙ্গীবাদ’। আর এভাবেই মোটর গ্যারেজের কর্মচারী ‘হিন্দু’ যাদব হয়ে গেল তথাকথিত ইসলামী শাসন কায়েমের ‘আত্মঘাতী জঙ্গী’। বিশ্বের ইতিহাসে আবিষ্কার হলো নতুন এক জঙ্গীতত্ত্ব। গ্রেফতার করা হলো যাদবের বৃদ্ধ-বাবা মাকে। থানায় আটক করে রাখা হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘হিন্দু জঙ্গী’ আবিষ্কার নাটক ভেস্তে গেল সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের কারণে। রাস্তায় নামল মানুষ। সোচ্চার হলো সচেতন মিডিয়া। বিক্ষোভ মিছিল-মিটিং-এ উত্তাল হয়ে উঠল নেত্রকোনা। এমন নেত্রকোনা এর আগে কখনও দেখেনি কেউ। দ্রোহের মুখে এক পর্যায়ে সেই বক্তব্যটিও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন প্রতিমন্ত্রী। জেএমবি নামধারী জঙ্গীদের বোমা হামলায় সেদিন আটজন প্রাণ হারান। এরা হলেন উদীচীর দুই শিল্পী খাজা হয়দার হোসেন, সুদীপ্তা পাল শেলী, যাদব দাস, রানী আক্তার, জয়নাল আবেদীন, আফতাব উদ্দিন, রইছ মিয়া ও আত্মঘাতী কিশোর কাফি (তার বাড়ি জামালপুরে, জেমএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানের বাড়ির কাছে)। আহত হন আরও ৯ পুলিশ সদস্যসহ ৫২ জন। এদের অনেকে শরীরে আজও বহন করছেন ঘাতক বোমার স্পিøন্টার। উদীচীর প্রিয় মুখ খাজা হায়দার জাগরণের গান করতেন। নাট্যকর্মী শেলীর অভিনয় শৈলীতে ফুটে উঠত প্রতিবাদী নারীর প্রতিচ্ছবি। যাদব দাস মোটর গ্যারেজে কাজ করে দরিদ্র বাবা-মার সংসারের হাল ধরেছিলেন। ভিক্ষাবৃত্তি করে পেটের ক্ষুধা মেটাতেন বৃদ্ধ জয়নাল। রইস উদ্দিন রিক্সা চালাতেন। আফতাব উদ্দিন মাছ বিক্রি করতেন জীবিকার প্রয়োজনে। কী দোষ ছিল এই নিরাপরাধ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর? আর কাফি নামে ষোল বছরের যে আত্মঘাতী কিশোর এই নারকীয় হামলা চালিয়েছিলÑ তারই বা কতটুকু দোষ? রাষ্ট্র, সমাজ বা ইসলামের আর কতটুকু জানত সে! তাকে তো নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে জীবন্ত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র। হাঙ্গেরির দার্শনিক লুকাচ বলেছেন, ‘কালচার ইজ দি এইম, পলিটিক্স অনলি দি মিনস্’। এর ভাবার্থ রাজনীতি হচ্ছে সংস্কৃতির শিখরে পৌঁছার উপায়মাত্র। আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ তা বিশ্বাস করুক আর না করুক, ধর্মান্ধ বা উগ্র জঙ্গীবাদীরা ভাল করেই জানেÑ রাজনীতির চেয়ে সংস্কৃতি বড়। রাজনীতি পাল্টাতে হলে বাঙালীর সংস্কৃতিকে আমূল বদলে দিতে হবে। নিঃশেষ করে দিতে হবে প্রগতি চর্চার ধারক-বাহকদের। এ কারণেই ওরা বারবার টার্গেট করে সংস্কৃতিকে। ওরা আমাদের সংস্কৃতিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে চায়। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যশোরের উদীচীর সম্মেলন, রমনা বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ময়মনসিংহের সিনেমা হল, নারায়ণগঞ্জের দনিয়ার মেলা, সিলেটের শাহজালালের (রঃ) মাজার, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ, পল্টনে সিপিবির সমাবেশ এবং নেত্রকোনার উদীচীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী বোমা হামলার ঘটনা একই গল্পের ধারবাহিকতা, একই লক্ষ্যে সংঘটিত। সুন্দর মানুষগুলো জেগে উঠলে অসুন্দর কখনও জয়ী হয় না। দেশ, সত্য ও সুন্দরের জন্য যারা জীবন দিয়ে গেছেনÑ তাদের ত্যাগকে পাথেয় করেই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। আশার কথা, দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিচারের রায় কার্যকর করছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছবার একটি ধাপ অতিক্রম করব মাত্র। তবে এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধাপরাধী, উগ্র-মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও জঙ্গী বা অন্য যে নামেই ডাকা হোক ওরা একই সুতোয় গাঁথা। সময়ের প্রয়োজনে কেউ কেউ ঘাপটি মেরে আছে। আবার কেউ ভিন্ন কৌশলে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলে আরও জোর দিতে হবে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। এখনই সময়। আর কোন হায়দার-শেলীকে হারাতে চাই না আমরা। দেখতে চাই না ‘নিউ ডাইমেনশন’ খ্যাত আর কোন নাটক। ’৭১ এর শহীদদের মতো ওরাও আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকুক। ওদের ত্যাগকে পাথেয় করে গতিশীল হয়ে উঠুক আমাদের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র। লেখক : সাংবাদিক ও উদীচী কর্মী
×