ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুজতবা আহমেদ মোরশেদ

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মোঃ আজিজুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মোঃ আজিজুর রহমান

বাংলাদেশের ভূখন্ড- এবং লাল সবুজের একটি পতাকা পাওয়ার জন্য যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারই অন্যতম পুরোধা বৃহত্তর দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান, এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য)। প্রবাসী সরকারের সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে মুজিবনগর সরকার এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানকে মুক্তিযদ্ধের ৭নং সেক্টরের সমগ্র এবং ৬নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার পদে দায়িত্ব প্রদান করে। (তথ্যসূত্র : ৩০ আগস্ট ১৯৭১ সালে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত গোপন পরিপত্র নং : ০০০৯জি/২)। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার হিসেবে তার সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। একইসঙ্গে তিনি পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক ক জোনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। (সূত্র : মুক্তিযোদ্ধা তালিকার লাল বই, স্মরণীয় যারা, বরণীয় যারা। পৃষ্ঠা নং ৯ এবং মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, ভলিউম নং ১৪।)। জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী ওই সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধিনস্ত সকলের জন্য তাঁর নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্য বিষয়েও পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার তাঁর ছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাঁর সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল। ওই সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদমর্যাদায় মোট দশজন নিযুক্ত ছিলেন এবং সবাই ছিলেন এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য)। স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান এবং সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। (দিনাজপুর ইনস্টিটিউটে সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। তথ্য : ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খ- নং ৫ । পৃষ্ঠা নং : ২৭৬) । আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, খ- নং ১৫)। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ ধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিত সিং আরোরার সঙ্গে মিলিত হন। তারই ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্র বাহিনীর অগ্রগামী দলের সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলায় গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন। তিনি ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য, ঠাকুরগাঁও, বালিয়াডাঙ্গি, রাণীশংকৈল এবং হরিপুর থানা) নির্বাচিত হন । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রট নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন (তথ্য : ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খ- নং ৫)। বৃহত্তর জিনাজপুর জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি ১৯৬০ - ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের জেল-জুলুমের ভয়ে রাজপথ থেকে যখন বেশিরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ালেন, এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান মাথায় গ্রেফতারের হুলিয়া নিয়েও জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতা-কর্মী নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকর সভাপতি) হিসেবে রুখে দাঁড়ান আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাঁর বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই উজ্জ্বল নেতার রাজনৈতিক পদযাত্রায় দেখা যায়, তিনি ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলা মুসলিম ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এরপর ১৯৪৪ সালে ডিস্টিংশনসসহ (সকল বিষয়ে ৮৫% নম্বর) তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ¯œাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজপুর বার কাউন্সিলে যোগদান করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করেন। এরই পাশাপাশি জনতার মাঝে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগাতে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক আওয়াজ নামে সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি সম্পাদক এবং মালিক হিসেবে এই পত্রিকার মাধ্যমে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। (তথ্য : ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খ- নং ৫ । পৃষ্ঠা নং : ২৫৫ এবং ৫৮২)। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতাত্তোর সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এর মর্যাদার বদলে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি অব বাংলাদেশ) হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অন্যতম কা-ারি এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের সূর্যসন্তান, সর্বস্বত্যাগী অকুতোভয় এই জননেতা মোহম্মদ আজিজুর রহমান ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। এরপর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ঘাসিপাড়াস্থ বাড়িতে নিভৃতে ইন্তেকাল করেন। দিনাজপুর শহরে সোনাপীর গোরস্তানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। লেখক : সাংবাদিক
×