ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সালেমা বেগম

মুক্তিযুদ্ধ ও আমার জীবন

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ ও আমার জীবন

আমার জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ নবেম্বর শুক্রবার ভোর রাতে, আলমডাঙ্গা নামের এক মফস্বল শহরে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বড় হয়েছি। যেমন হরিণাঘাটা, দামরুদা, তেহাটা, চুয়াডাঙ্গা ইত্যাদি। সুন্দর একটা নদীর কাছে আমাদের বাড়ি ছিল। আমার বাবা ব্রিটিশ সরকারের একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। আমি বাবার প্রিয় কন্যা। বাবা যখন বাগেরহাটে তখন আমার বিয়ে হয় ডাঃ এম এ সিকদারের সঙ্গে। তিনি আমার ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন। আমার বিয়ে হয় ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। তখন আমি ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী। আমার প্রথম সন্তান মেয়ে, ১৯৪২ সালে তার জন্ম। তখন মহাযুদ্ধের দাবানল। সেই বছরই বা কিছু পরে রায়ট হয় ভারতের নানা কোণে। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, অন্যদিকে রায়ট। কলকাতা থেকে আমার স্বামী এবং আমার ভাই বরিশাল চলে আসল। এরপর ১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল। আমার বাবা তখন খুলনায় ছিলেন। খুলনা থেকে বাবা বদলি হলে ১৪ দিনের মেয়ে নিয়ে মোল্লারহাটে যাই। আমার বড় ছেলের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালের ১৯ মে। ছোট ছেলের জন্ম হয় ১৯৫০ সালের ১৪ মার্চ, বাগেরহাটে। আমার ছোট মেয়ের জন্ম হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ৯ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে। বড় ছেলের জন্ম অভয়নগর। সেখানেই আমার বাবা রিটায়ার্ড করেন। বাবা বাড়ি করেন মানিকগঞ্জে। চল্লিশ দিনের ছেলে নিয়ে আমি মানিকগঞ্জে যাই নতুন বাড়িতে। ’৭১-এ বড় ছেলে যখন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করছে এবং ছোট ছেলে যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে তখন তারা দুজন যুদ্ধে যায়। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারি ও মার্চের শুরু থেকেই মনে হলো পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসছে। ৩ মার্চ ‘ফারুক হোসেন’ নামক এক যুবককে মৌচাক মার্কেটের সামনে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনারা। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আমি ও আমার পরিবারের সবাই রেডিওর মাধ্যমে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম আমরা আগামীর লড়াইয়ে, স্বাধীনতা লড়াইয়ে জিতব। ৯ মার্চ আমার বড় ছেলে সেলিম রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে চলে আসে। কারণ, ওদের কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। সে ঢাকা এসে সমস্ত শহর ঘুরে ঘুরে দেখে। সেলিম বুঝতে পারে পাকিস্তানীরা বাঙালীদের দমনে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। বড় ছেলে সেলিম এসে বলল, ‘মা টিক্কা খান নামে এক পাকিস্তানী সামরিক প্রধান এসেছে, সে নাকি কাঁচা মাংসখাদক। দেশটা এবার কোথায় যাবে যে মা! হঠাৎ ২৫ মার্চ শুরু হলো পাকিস্তানীদের নির্মম হত্যাকা । মাঝরাতে বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনারা এবং রক্তে ভিজিয়ে দেয় পুরো ঢাকা শহর ও দেশের নানা স্থান। তখন আমার দুই ছেলে সেলিম আর হাসান আমাকে বলল, ‘ভয় পেও না, আমরা আছি তোমার সঙ্গে। দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতে তোমাদের কোন ক্ষতি হতে দেব না।’ বড় ছেলে সেলিম ছিল খুবই সাহসী। ও বলল, মা দেখ আমার এক হাতে রাম দা, অন্য হাতে বল্লম, আর রাইফেল ও গুলি তো আছেই। এ নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন? তোমার ছেলেরা আছে তো। কিছু না পারি কম করে হলেও তিনজন পাকিস্তানীকে হত্যা করে তবে তো মরব। আমি বললাম, ‘খোকা আমি ভয় পাইনি’। আমাদের বাসা ছিল সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরের দো’তলায়। কারণ, আমার স্বামী ছিলেন তেজগাঁও সেন্ট্রাল মেডিক্যালের ডাইরেক্টর। ২৫ মার্চ রাতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সেই যুদ্ধে কয়েক শ’ বাঙালী পুলিশ নিহত হলো। রাজারবাগ এলাকা সারা রাস্তায় শুধু পুলিশের লাশ। রক্তাক্ত বীভৎস সেইসব লাশ উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে ছিল। যারাই তাদের দেখতে গিয়েছিল, তারাই গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল সেইসব মরদেহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐ রাতে পাকিস্তানী সেনারা প্রায় গুঁড়িয়ে দেয় শহীদ মিনার। ইকবাল হল, ঢাকা হল এবং জগন্নাথ হলের ছাত্র ও শিক্ষকদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনারা। যারা জীবিত ছিল তাদের বাঙ্কারের ভেতরে ফেলে ওপরে মাটিচাপা দিয়ে জীবিত কবর দেয়া হয়। এসব কথা শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ছেলেদের যুদ্ধে পাঠাব। ওদের ডেকে বললাম, ‘তোমাদের যুদ্ধে পাঠাব, তোমরা কি বলো’? আমার ছেলেরা বলল, ‘মা আমরাও তাই ভাবছি, মুরগিছানার মতো ঘরে বসে থাকার চেয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করে মরব। আমার দুটি সন্তান- সেলিম ও হাসানকে যুদ্ধে পাঠালাম। যাবার সময় বললাম, যাচ্ছ বীরের মতো, আসবে বীরের মতো; পিঠে গুলি নিয়ে ফিরবে না- এ আমার বিশ্বাস। যুদ্ধে যাবার সময় আমি নিজ হাতে আমার বাসার গেট খুলে দিলাম। ১৪ এপ্রিল আমার তেজগাঁও বাসা থেকে কিছুটা দূরে একটি বাসায় পাকিস্তানী সেনারা হামলা করল। ঐ বাসাতে চারজন সদস্য ছিল। তাদের নির্মমভাবে হত্যা করল তারা। তাদের অপরাধ ছিল ৪ বছরের এক বাচ্চা ‘জয় বাংলা’ বলেছিল। ঐ ছোট বাচ্চাটিকে হত্যা করে নরপিশাচ পাকিস্তানী বাহিনী। বাংলাদেশের পতাকা ঐ শিশুর মাথায় ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। শিশুটির মাকে ধর্ষণ করে, তার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে ঐসব নরাধম। আমি আরও ভয় পেলাম মেয়েদের নিয়ে, কোথায় যাব? বাসায় মেয়েদের লুকিয়ে রাখতাম। এর মধ্যে একটি অজানা ফোন এলো। একজন আমাকে বলল আপনার ছেলেরা ভাল আছে। ওরা যুদ্ধ করছে দেশের জন্য। আমি হ্যালো হ্যালো বলে জানতে চাইলাম তাদের অন্যান্য খবর। কেটে গেল ফোন। জানতে পেরেছিলাম ওরা ভারতের মূর্তি নামক একটি জায়গায় আছে। মে মাসের প্রথম দিকে, আমার বাসার কাছে ডিএলআর অফিসের ভিতর থেকে একজন বড় কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানীরা। পরে তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। এরকম অসংখ্য ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে, যা দেখে শুনে শিউরে উঠতাম। জুনের প্রথম সপ্তাহে আমার স্বামী রাজশাহী বিভাগের স্বাস্থ্যপ্রধান হয়ে বদলি হয়ে গেলেন। আমি তখন দুই মেয়ে নিয়ে আরও বিপদে পড়লাম। আতঙ্কের মধ্যে জুন মাস কাটালাম। তেজগাঁও থাকাকালীন মানিকগঞ্জের বামনেতা আনোয়ার চৌধুরী স্বাধীন বাংলার কতগুলো পেপার এনে আমাকে বলল, ‘এগুলো কপি করে দিতে পারবেন?’ আমি বললাম ‘পারব’। সে আমাকে পেপারগুলো দিল, আমি কপি করেদিলাম। এভাবে আমি প্রতিদিন পেপার কপি করে দিতাম। এটা আমার একটি কাজে পরিণত হলো- স্বাধীন বাংলার জন্য। জুলাই মাসে যুদ্ধ যেন আরও ভয়ানক রূপ নিল। তখন অনেক সাধারণ মানুষ ছাড়াও অনেক সৈন্য হতাহত হতে লাগল। আমি তখন সেবার কাজে যুক্ত হলাম। তাদের প্রয়োজনে গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, আয়োডিন পাঠিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে শীত এসে গেল। আমি ৭৫০টি কম্বল পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ২ নং সেক্টরের সৈন্যদের জন্য। ক্যাপ্টেন হালিমের লোকজন এবং আমাদের শ্রমিক নেতা আজিজ তা নিয়ে গেল। এর মধ্যে আমরা স্বাধীন বাংলা রেডিও শুনতাম। আমার কলিজার টুকরা ছেলেদের কোন খবর যদি পাই! ওদের জন্য এত চিন্তা হতো! মনে হতো ছেলেদের কি একবার দেখে মরতে পারব? আমার ছেলে দুটো কেমন আছে, কোথায় আছে, আমি কিছুই জানতে পারিনি। ঐ সময়টাতে আমার মেয়েদের খাটে ঘুমাতে দেইনি, ভাল খাবার খেতে দেইনি। ওদের বলতাম, ‘আমার ছেলেরা কি অবস্থায় আছে! ওরা কি খাবার খেতে পারছে!’ আমার মেয়েরা তখন বলল, ‘মা ভাইয়ারা ফিরে আসুক, তখন এক সাথে সবাই বসে খাব। ভয়ে কোথাও বের হতাম না, মেয়েদের শব্দ করে কথা বলতে দিতাম না, চুলা জ্বালিয়ে রান্না করতাম না, যদি আগুনের আলোতে পাকিস্তানী সৈন্যরা বুঝতে পারে এই বাসায় লোক বসবাস করছে। ১৪ আগস্ট তেজগাঁও থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত বেলুন ও ‘জয় বাংলা’ পতাকায় ছেয়ে গেল। আর পাকিস্তানী সৈন্যরা সেটাকে গুলি করে, টেনে-হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলছে। ভাবলাম বাংলার স্বাধীনতা আসতে আর বেশিদিন বাকি নেই। শীঘ্রই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে মনে হচ্ছে। এভাবে চলে এলো সেপ্টেম্বর মাস। বিবিসির খবরে শোনা যায় বাঙালীরা সব জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাজিত করছে। ছেলেদের কোন খবর নেই। প্রার্থনা করতাম আমার ছেলেরা এবং সব মায়ের সন্তানেরা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তারা যেন ভাল থাকে, সুস্থ থাকে। তারা যেন বাংলাদেশকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা করে। অক্টোবর মাসে জানতে পারলাম মূর্তি নামক জায়গায় যেসব ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যুদ্ধ করছে, তাদের সেক্টর ভাগ করে দেয়া হয়েছে। আমার ছেলেদের নাকি ৩ নং সেক্টরে যুদ্ধ করতে হবে। তারা নাকি ওখানে এসেছে। দেশের জন্য যুদ্ধ করছে। ৩ নং সেক্টর প্রধান কর্নেল শফিউল্লাহর আন্ডারে ছিল আমার ছেলেরা। আমি তখনও তেজগাঁও বাসায় ছিলাম। নবেম্বর মাসে চারদিকে ‘জয় বাংলার’ গান শোনা যাচ্ছিল। মনে মনে ভাবতাম এই বুঝি বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। এভাবে চিন্তা করে করে দিন কাটতে লাগল। প্রতিটা দিন এখানে মৃত্যু ওখানে বোমা পড়ার কথা শুনে শুনে মনটা যেন পাথর হয়ে গেল। এভাবে এলো ডিসেম্বর মাস। ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের তেজগাঁও অফিসটা দখল করে নিল। আমি একজন বাঙালী ডাক্তারকে বললাম, ‘আমি এখন কোথায় যাব’? বাঙালী ডাক্তার বললেন, ‘আপনারা এখান থেকে চলে যান।’ এখানে আপনাদের কোন নিরাপত্তা থাকবে না। আমার বোন থাকত গোপীবাগ। ঠিক করলাম বোনের বাসায় মেয়েদের নিয়ে যাব। ৩ তারিখে সকালে ডগফাইট দেখলাম, তেজগাঁও বাসার দোতলা থেকে দুটি বিমানÑ একটি ভারতের, অন্যটি পাকিস্তানের। উভয় বিমান শেলিং করছে এর মধ্যে পাকিস্তানী বিমান ধ্বংস হয়ে গেল। আর ভারতের বিমান চলে গেল। পরে শুনতে পারলাম ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করছে। তখন আমি চিন্তা করলাম, সত্যি এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। আমি মেয়েদের নিয়ে বোনের বাসার চলে গেলাম। ঢাকা শহরে তখন কোন গাড়ি ছিল না। একটা ঠেলাগাড়ি করে মেয়েদের বোনের বাসায় নিয়ে গেলাম। বোনের গোপীবাগ বাসায় থাকাটা নিরাপদ হবে না বলে মালিবাগে আরেক বোনের বাসার চলে গেলাম। এর মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর জানতে পারলাম পাকিস্তানীরা সারাদেশে ‘কারফিউ এবং ব্ল্যাক আউট’ জারি করেছে। ১৬ তারিখ সকালে জানতে পারলাম কমলাপুর রেল স্টেশনে ‘জয় বাংলা’ পতাকা উড়ছে। সংবাদ পেয়ে গিয়ে দেখলাম হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈন্য মাথা নিচু করে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে আত্মসমর্পণের জন্য। ওই দৃশ্য দেখে খুব ভাল লাগল আর মনে হলো এই বুঝি বাংলাদেশ স্বাধীন হলো! এদিকে মুক্তিবাহিনী ডেমরা হয়ে ঢাকায় আসছে। ভাবতে পারিনি এদের নেতৃত্বে আমার ছেলেরা। বেতারে শুনতে পারলাম দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৬ তারিখে আমার বোনের স্বামী এসে বলল, আপা আপনার বড় ছেলে সেলিম ফিরে আসছে ও আপনার সঙ্গে দেখা করবে দেড়টার সময়। ও ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছে ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আমি ‘মা’ অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছি কখন আমার ছেলে আমার বুকে ফিরে আসবে! আমাকে মা বলে ডাকবে! অবশেষে আমার ছেলে সেলিম আসল। আমার ছেলে আমার কাছে এসে বলল, ‘মা’ আমি ফিরে এসেছি তোমার কোলে। আমি গর্বিত মা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পেরে। আমার ছেলেটা কিছুক্ষণ পর আমাকে বলল, ‘মা’ আমার সঙ্গে অনেক সেনা এসেছে এখানে থাকতে, সমস্যা হবে। আমি বাসা ভাড়া করে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। এর মধ্যে আমার ছোট ছেলেটা ফিরে এলো। ও চলে গেল রেসকোর্স জীমখানা ক্লাবে। সেখান থেকে চলে গেল পুরনো হাইকোর্টে। আমি ওদের ফিরে পেয়ে শান্তি পেলাম। এর মধ্যে আমার বোন ড. দেবের পালিতা কন্যা রোকেয়া বলল, দেখ তোরা যদি ড. দেবের বাসাটা পাস তাহলে ভাল হয়। অবশেষে তাই হলো, আমরা ঐ বাসাটাই পেলাম। সেই বাসায় যাবার পর ১৮ তারিখ সকালে শুনলাম যে, দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের ১৪ তারিখে হত্যা করেছে পাকিস্তানীরা। আমি ও আমার বোন দেখতে গেলাম তাদের রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ৩৫০ জনকে তারা হত্যা করেছে নির্মমভাবে। ১৪ থেকে ৭০ বছর বয়সের মানুষগুলোকে হত্যা করেছে পাকিস্তানী বাহিনী এবং এ দেশীয় আলবদররা। এ কেমন হত্যা? কারও দেহে একাধিক গুলি, কারও চোখ তুলে নিয়েছে, কারওবা পা, কারওবা হাত, কারও আবার মাথা কেটে ফেলেছে এমন চিত্রে চোখ রাখা যায় না। ঐ দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। এসব দেখে বাসায় ফিরে আসলাম। আসার পর শুনলাম আমার বড় ছেলের পোস্টিং হয়েছে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির অধীনে গার্ড বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে। বঙ্গভবনের মধ্যে সেলিম কোয়ার্টার পেল। ছোট ছেলের পোস্টিং হলো পিলখানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ক হিসেবে। ২৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে সেলিম বাসায় ছুটিতে এলো। এসে বলল, মা এবার দেশের বাড়ি বরিশালে যাব। ঈদে গরু কোরবানি দেব ওখানে। আমাকে ২৪ জানুয়ারি বরিশালে পাঠিয়ে দিল। সেলিম বরিশালে গেল ২৭ জানুয়ারি। ২৮ জানুয়ারি ঈদ হলো ও নিজের হাতে মাংস সবার মাঝে বিলিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর আমাকে বলল, মা আমি ইলিশ পোলাও খাব। আমি বললাম, ইলিশ পোলাও খেলে মাংস খাবে কে? তুমি তো খাবে না, আমাকে শুধু শুধু রান্না করাবে। ঈদের পর খেও, তোমার বোনের কাছে রান্না করে পাঠিয়ে দেব। সেদিন আর ইলিশ পোলাও রান্না করা হলো না। ঈদের পরের দিন অর্থাৎ ২৯ তারিখে ঢাকা ফিরে গেল সে। ঐ ২৯ তারিখে ওর ওপর দায়িত্ব আসল মিরপুর বিহারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ঢাকার মিরপুর তখনও মুক্ত হয়নি। সেখানে বিহারীরা বাঙালীদের গলা কেটে জবাই করছে। তখন সরকার থেকে আমার বড় ছেলে লে. সেলিমসহ শতাধিক পুলিশ অফিসার ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যকে সেখানে পাঠানো হলো। ১৯৭২-এ ৩০ জানুয়ারি সকাল ১০টায় মিরপুরে গোলাগুলি শুরু হলো। বুকে গুলি নিয়েও সেলিম বিকেল ৫টা পর্যন্ত যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যায়। তার সঙ্গে শহীদ হন ৪১ জন সেনা এবং অসংখ্য পুলিশ ও মুক্তিবাহিনীর ছেলে। গাজীর মা থেকে আমি শহীদের মা হয়ে গেলাম। আমার দুই ছেলে সেলিম ও আনিস অত্যন্ত সাহসী ছিল। এজন্য আমি বুকভরা আশীর্বাদ দিয়ে তাদের যুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম আর বলেছিলাম, বাবা তোমরা সাহস নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছ; কিন্তু পিঠে গুলি নিয়ে নয়, বুকে গুলি নিয়ে আসবে। আমার কথা রেখেছিল সেলিম। সে পিঠে নয়, বুকে গুলি নিয়ে শহীদ হলো। ৩১ তারিখ মিরপুর মুক্ত হলো। মিরপুর তো মুক্ত হলো কিন্তু আমার কলিজার টুকরা সেলিম আর ফিরে এলো না। ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বললেন, সেলিমের লাশ পাওয়া গিয়েছে। তাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হলো। আমি আমার সন্তানকে বিদায় বেলা দেখতে পারিনি। আজও লাখো শহীদের মাঝে আমার সন্তানকে খুঁজে বেড়াই। কোনদিন সে আর ফিরে আসবে না। হয়ত মৃত্যুর মাঝে শেষ হবে আমার প্রতীক্ষা। অনুলিখন : শাহীনা হাফিজ ডেইজি, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭
×