ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ দুর্যোগ-দুর্ভোগ বালা-মুসিবত

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ দুর্যোগ-দুর্ভোগ বালা-মুসিবত

(গত সপ্তাহের পর) আমরা যদি কুরআন মজীদ থেকে বিশ্বজগত সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে সচেষ্ট হই তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করার অধিকার আমাদের নেই। আমরা অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কর্তন করে, বনভূমি উজাড় করে, নদ-নদীর প্রাকৃতিক পানি প্রবাহকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে কিংবা বাঁধ দিয়ে নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে, যুদ্ধ বাঁধিয়ে বারুদের বিষাক্ত ধোঁয়া জীবাণু গ্যাস ছড়িয়ে, ওজোন স্তরকে ক্ষতবিক্ষত করে নিজেদের হাতেই নিজেরা এ পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি, আমরা নিজেরাই অকাল বন্যা ডেকে আনছি, আকাল-রোগ-শোক নেমে আসছে, শক্তি দম্ভ দেখাতে গিয়ে মানুষ মানুষের দুশমনে পরিণত হচ্ছে, মানবতা নীরবে-নির্জনে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে, দুর্যোগ-দুর্ভোগ, বালা-মুসিবত কুরে কুরে জর্জরিত করছে মানবতাকে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমিই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করে তাতে উদ্গত করি কল্যাণকর উদ্ভিদ। (সূরা লুকমান : আয়াত ১০)। স্বভাবতই বলতে হয় আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যে পরিকল্পনায় পৃথিবীটাকে সুশোভিত ও সুনিয়ন্ত্রিত করেছেন, প্রকৃতির শোভা-সৌন্দর্য যে নিয়মে সৃষ্টি করেছেন সেই নিয়মে নিয়ন্ত্রিত পরিমিতির পরিপন্থী কোন কিছু করাটাই হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করা এবং পৃথিবীর স্বাভাবিকত্বকে বিনষ্ট করা। কুরআন মজীদে অনেক দুর্যোগের বিবরণ রয়েছে যার থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। হযরত নূহ ‘আলায়হিস সালামের’ আমলের মহাপ্লাবনের কথা কুরআন মজীদে রয়েছে। আল্লাহ্র নির্দেশে হযরত নূহ ‘আলায়হিস সালাম’ একটা বিশাল কাঠের জাহাজে জোড়ায় জোড়ায় জীব-জন্তু, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, তৃণলতা এবং মানুষ তুলে নিয়ে ধ্বংসের হাত থেকে সে সবকে রক্ষা করেছিলেন। জানা যায় কাষ্ঠনির্মিত সেই বিশাল জাহাজখানি তিনতলা বিশিষ্ট ছিল। এই জাহাজের দ্বিতীয় তলায় ছিল মানুষ। ৪০ দিন পর সেই মহাপ্লাবনের পানি সরে গেলে হযরত নূহ ‘আলায়হিস সালাম’ জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন। তাঁর এই আল্লাহ্ নির্দেশিত ত্রাণকার্যের ফলে পৃথিবীর জীবজন্তু, পশু-পাখি এবং মানব নিঃশেষ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পায়। কুরআন মজীদে বহু সভ্যতার উত্থান-পতনের কথা বর্ণিত আছে। ছামুদ জাতির ধ্বংসের কথা উল্লিখিত রয়েছে। ছামুদ জাতি বিরাট বিরাট পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করত। এই জাতিকে হিদায়াত দান করার জন্য আল্লাহ্র নবী হযরত সালেহ ‘আলায়হিস সালাম’ বহু চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারা তাঁর হিদায়াত গ্রহণ করেনি। ফলে এক রাতে ভূমিকম্পের আঘাতে তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কুরআন মজীদে ছামুদ জাতির কথা বলতে গিয়ে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর ভূমিকম্প দ্বারা তারা আক্রান্ত হলো, তাঁদের প্রভাত হলো নিজগৃহে অধঃমুখে পতিত অবস্থায়। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ৭৮), অতঃপর যারা সীমা লঙ্ঘন করেছিল মহানাদ (ভূমিকম্পের প্রচ- আওয়াজ) তাদের আঘাত করল ফলে ওরা নিজ নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল, যেন তারা সেখানে কখনও বসবাস করেনি। জেনে রাখো! ধ্বংসই হলো ছামুদ জাতির পরিণাম। (সূরা হূদ : আয়াত ৬৭-৬৮)। মানুষের ওপর দুর্যোগ-দুর্ভোগ, বালা-মুসিবত যে মানুষের কর্মদোষেই নেমে আসে সে সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তো তিনি (আল্লাহ্) ক্ষমা করে দেন। (সূরা শূরা : আয়াত ৩০)। মানুষের কৃতকার্যের জন্য দুর্যোগ-দুর্ভোগ, বালা-মুসিবত যেমন আসে তেমনি আবার ক্ষেত্রবিশেষে তা আসে পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তোমাদের ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে অবশ্যই পরীক্ষা করব। (হে রসূল) আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন- আমরা তো আল্লাহ্রই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৬)। দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে যারা সেই দুঃখ-কষ্টকে, সেই বিপদ অবস্থাকে সহ্য করে তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়, তাদের রীতিমতো বীর অভিধায় অভিহিত করলে অত্যুক্তি হয় না। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ফাইন্না মা’আল ‘উস্রি ইউস্রা, ইন্না মা’আল ‘উস্রি ইউস্রা- কষ্টের সঙ্গেই তো স্বস্তি আছে, অবশ্যই কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি আছে। (সূরা ইনশিরাহ্ : আয়াত ৫-৬)। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য ত্রাণকার্য পরিচালনা করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ইন্নাল্লাহা লা ইয়াজলিমুন্নাসা শায়আও ওয়ালাকিন্নান্নাসা আন্ফুসাহুম্ ইয়াজইলমুন নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের প্রতি কোন জুলুম করেন না বরং মানুষই নিজেদের প্রতি জুলুম করে থাকে। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৪৪)। আমরা দেখতে পাই আল্লাহ্ নবী হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস সালাম দজ্লা নদীতে একটি বিশাল মাছের উদরস্ত হয়ে সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য একটি দোয়া পাঠ করেছিলেন আর তা হচ্ছে : লা ইলাহা ইল্লা আন্তা-সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্ জলিমীনÑ আপনি (আল্লাহ) ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই; পবিত্রতা ও মহিমা আপনারই, নিশ্চয়ই আমি জালিমদের অন্তর্গত হয়ে গেছি। (সূরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৭)। আল্লাহ্র বিনা অনুমতিতে আল্লাহ্র নবী হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস সালাম’ দেশ ত্যাগ করেছিলেন, যে কারণে তাঁকে ওই মুসিবতের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তিনি তাঁর ত্রুটি স্বীকার করে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমার জন্য দোয়া করলে আল্লাহ্ তাঁকে মুসিবত থেকে উদ্ধার করেন। আমরা আরও লক্ষ্য করি যে, শয়তানের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে ভুলক্রমে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ায় হযরত আদম ‘আলায়হিস সালাম ও মা হাওয়া ‘আলায়হাস্ সালাম জান্নাতের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা হারান, এমনকি পোশাকও। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাদের সম্বোধন করে বললেন : আমি কি তোমাদের এই বৃক্ষটির নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি এবং আমি কি তোমাদের বলিনি যে, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন? (সূরা আ’রাফ : আয়াত ২২)। সেই ভীষণ মুসিবতের সময়, সেই দুর্যোগ-দুর্ভোগকালে আদম-হাওয়া মুক্তি পাওয়ার জন্য যে দোয়াটি দীর্ঘকাল ধরে পরস্পরে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে পাঠ করেছিলেন তা হচ্ছে : রব্বানা জলামনা আন্ফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগর্ফিলানা ওয়ার্তাহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসিরীনÑ হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি, আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ২৩)। দুর্যোগ-দুর্ভোগে, বালা-মুসিবতে আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে আল্লাহ্র নিকট বিপদ মুক্তির জন্য দোয়া করা কর্তব্য এবং সেই সঙ্গে বালা-মুসিবতে নিপতিত ব্যক্তিদের সাহসভরে ধৈর্য সহকারে আল্লাহ্র ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখে তা মোকাবেলা করা উচিত এবং অন্যদের উচিত সেই সব দুর্গত মানুষের মুসিবত যাতে দূর হয় তার জন্য দোয়া করা এবং তাদের দুর্গতি ও কষ্ট দূর করার জন্য জরুরী উদ্যোগ ও তাবত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে তাদের মদদ যোগানো, তাদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সমাপ্ত লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×