ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

বিশ্ব অনুসৃত মডেলে বৈষম্য হ্রাস সম্ভব নয়

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

বিশ্ব অনুসৃত মডেলে বৈষম্য হ্রাস সম্ভব নয়

গত সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় খবর ছিল ডলার। ডলারের মূল্য বাড়ছে। বাজারে ডলারের অভাব। চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ছাড়ছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেক ব্যাংক এই সুযোগে ডলারের দাম নির্ণয়ে যথেচ্ছাচার করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। কিন্তু ফল মনে হয় শূন্য। খোলাবাজারে, কার্ব মার্কেটে উভয়স্থলেই মূল্য উর্ধমুখী। ডলারের দাম উর্ধমুখী হলে ক্ষতি কী? ক্ষতি-বৃদ্ধি উভয়ই আছে এই ক্ষেত্রে। দেখা যাচ্ছে ‘রেমিটেন্স’ প্রাপকরা দারুণ খুশি। এতদিন তাদের অভিযোগ ছিল ডলারের মূল্য কম, টাকার তেজি ভাব। তাই তারা ক্ষতিগ্রস্ত। এবার তারা খুশি। এক ডলারে তারা ৮২-৮৩ টাকা পাচ্ছেন। এতে গ্রামের বাজার তেজি হবে। ‘ভোগব্যয়’ (কনজামশন) বাড়বে। এটা ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির সহায়ক। এই অর্থে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়াতে রেমিটেন্স প্রাপক এবং প্রেরক উভয়ের মধ্যে বেশ উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই মিডিয়াওয়ালারা বলা শুরু করেছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়াতে ‘রেমিটেন্স’ গত মাসে বেশ বেড়েছে। অক্টোবর মাসে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১১৬৩ মিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে নবেম্বরে এসেছে ১২১৫ মিলিয়ন (দশ লাখ) ডলার। সুখবর। কিন্তু তা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বেড়েছে এর প্রমাণ কী? প্রমাণ তো দরকার। সে যাই হোক মোটের ওপর রেমিটেন্স নবেম্বর মাসে বেড়েছে এটাই সত্য কথা। এদিকে দেখা যাচ্ছে রফতানিকারকরাও খুশি। তারা মাল বিক্রি করে বেশি। গার্মেন্টস রফতানি বাড়বে এই তাদের প্রত্যাশা। কারণ তাদের মাল ডলারের হিসাবে কমবে। তাই চাহিদা বাড়বে। কিন্তু এসব সুখবরেও বাংলাদেশ ব্যাংক খুশি নয়। তাদের হিসাব অন্যত্র। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে দারুণ সমস্যা হবে। তারা বহু চেষ্টা করে ডলারের মূল্যকে স্থিতিশীল রেখেছে অনেক দিন ধরে। আটাত্তর-ঊনআশি-আশি এই বৃত্তের মধ্যে ধরে রেখেছে ডলারের মূল্য। কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য লাফালাফি করলে উদ্বিগ্ন হয়? এর কারণ একটা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। ইতোমধ্যে খবরের কাগজের খবর চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে বাজারে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল আসে সেখানে ব্যবসায়ীরা চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে কেজিপ্রতি এক টাকা। যুক্তি ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। আমদানি পর্যায়েই এক টাকা বৃদ্ধির অজুহাতে পাইকারি ও খুরচা পর্যায়ে চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে দুই-তিন টাকা। এটা ‘মিডিয়ার’ খবর। এই একটা খবরেই বোঝা যায় ডলারের মূল্যবৃদ্ধি কি সর্বনাশা করতে পারে। আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। চাল-ডাল-নুন-তেল থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য এবং যন্ত্রপাতি সবকিছুই আমাদের আমদানি করতে হয়। অতএব ডলারের মূল্যবৃদ্ধি মানেই সকল আমদানিকৃত মালের মূল্যবৃদ্ধি। এতে দেশী শিল্পের যেমন বারোটা বাজে, তেমনি সর্বনাশ হয় সাধারণ ক্রেতাদের। ইতোমধ্যেই এই লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এমনিতেই ব্যবসায়ী বন্ধুরা ছেড়ে কথা বলেন না। আর এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ভীষণ বড় সুযোগ। ছাড়াছাড়ি নেই। ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা কোনদিন ছেড়ে কথা বলেন না। সুযোগ চাই। এই মুহূর্তে আরেকটি বড় সুযোগ হচ্ছে বিমান কোম্পানিগুলোর। হোটেল মালিকদের বড় সুযোগ। ডিসেম্বর মাস। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। পরীক্ষা হয়ে গেছে। অভিভাবকদের ওপর বাচ্চাদের চাপÑবেড়াতে নিয়ে যাও। খুবই ন্যায্য চাপ। কারণ ঢাকায় এখন বাচ্চাদের খেলাধুলা করার সুযোগ নেই। মাঠ নেই। চিত্ত বিকাশের কোন সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় যখনই তারা একটু বেড়াতে যেতে চায় তখনই বিমানের টিকেটের চড়া দাম। হোটেলের বুকিংয়ে চড়া দাম। এর নাম চাহিদা। এর নাম বাজার অর্থনীতি। বাজার অর্থনীতি নয়Ñ উগ্র ও আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি। সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীরা গ্রাহককে, ভোক্তার ঘাড়ে চেপে বসে। তা না হলে হঠাৎ করে এই মাসে বিমানের টিকেট, হোটেল বুকিংয়ে ‘চার্জ’ দেড়গুণ-দ্বিগুণ হবে কেন? যারা বেড়াতে যাবেন তাদের আয় কি এই মাসে বাড়ে? এই মাসে কী বেতন-ভাতা বাড়ে? না, কিন্তু মধ্যবিত্তকে এই বাড়তি খরচ বহন করতে হয়। তাই নয় কী? মধ্যবিত্ত সারা জীবন বাড়তি বোঝা বহন করতে করতেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে সবজির বাজারেও সেই স্বস্তি নেই। সবজির বাজার ৭০-৮০ টাকা কেজিতে উঠে এখন একটু পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু মজার বিষয় আছে এখানে। মূল্য কিন্তু বৃদ্ধি-পূর্ব পর্যায়ে আর ফিরে যাচ্ছে না। ৩০-৪০ টাকার স্তর পেরিয়ে এখন তা ৫০-৬০ টাকায় স্থিতি পেতে চেষ্টা করছে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে বাজার এভাবেই ধীরে ধীরে উর্ধমুখী হয়। একসময় এই প্রবণতা দেখে মনে হতো দ্রব্যমূল্য কমানো যায়। এ কারণে কত আন্দোলন, সংগ্রাম করেছি। কত মিছিলে গিয়েছি। গগন বিদারী আওয়াজ ‘জিনিসপত্রের মূল্য কমাতে হবে।’ হাতে হাতে ফেস্টুন, পোস্টার। বুকে-পিঠেও একই লেখা। কিন্তু আজ বলাই দরকার এই দাবিটির কোন সারবত্তা নেই। এই জিনিসটি কোনদিনই হওয়ার নয়। টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমবেই, জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই এর থেকে রেহাই নেই। বলাই প্রয়োজন মূল্যবৃদ্ধি ‘উন্নয়নের’ সহযাত্রী। যত উন্নয়ন তত বেশি মূল্যবৃদ্ধি। উন্নয়ন হচ্ছে, মূল্য কমছে বা মূল্য স্থিতিশীল থাকছে এই উদাহরণ বিরল। প্রশ্ন শুধু মূল্যস্ফীতির হার কত সহনশীল রাখা যায়। এই জায়গাটাতেও আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অসহায়। তারা স্বাধীনতার পর গত ৪৬ বছরে যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজে সফল হতো তাহলে ছোট্ট এক হালি সবরিকলা ২৫ টাকা দরে কিনতে হতো না। পাকিস্তান আমলে এর দাম দুই আনাও ছিল না। দুই আনা মানে ১০-১২ পয়সা। প্রতিটি জিনিসের দাম এক শ’, দেড় শ’, দু’শ’ গুণ বেড়েছে। কেবল ব্যতিক্রম চালের দাম। মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা ধরলেও পাকিস্তান আমলের (১৯৭০) তুলনায় তত বাড়েনি যত বেড়েছে অন্যান্য জিনিসের দাম। আমার প্রশ্নটা মূল্যবৃদ্ধিতে নয়। ধরেই নিয়েছি ‘উন্নয়নের’ বন্ধু হিসেবে মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ঘটবে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এ ক্ষেত্রে বাঁচার ব্যবস্থা হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি। প্রশ্ন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বা যেহারে বেড়েছে মানুষের আয়, মানুষের মজুরি কী সেভাবে বেড়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ঢালাওভাবে কিছু বলা যাবে না। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কিছু লোকের আয়-রোজগার বেড়েছে মারাত্মক হারে। শত শত গুণ তাদের আয় বেড়েছে। আর কোটি কোটি লোকের আয় বেড়েছে নামমাত্র। এখানে অবশ্য বেকার, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, চাকরিচ্যুতদের কথা বলছি না, তাদের হিসাব আলাদা। অবসরপ্রাপ্তদের হিসাব আলাদা। দুস্থ, প্রতিবন্ধীদের হিসাব আলাদা। এই শ্রেণীর লোক বাদে বাকিদেরই আয় সেভাবে বাড়েনি। যেভাবে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। সমস্যাটা এখানেই সৃষ্টি হচ্ছে। বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে না শুধু এটা দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। দৃষ্টিকটু বললে কম বলা হয়, এটা সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশের শিল্পসম্পদ, গৃহসম্পত্তি-সম্পদ, জমিজমা সম্পদ, আর্থিক (ফিন্যান্সিয়াল) সম্পদ, ব্যাংক-বীমা-লিজিং কোম্পানির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে খুবই সীমিত সংখ্যক লোকের হাতে। এর ফল কী? এসব কী ‘উন্নয়নের’ সহযোগী ফসল? আমি মনে করি তাই। আমাদের দেশসহ সারা বিশ্ব যে উন্নয়নের ‘মডেল’ নিয়ে এগোচ্ছে তাতে এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটা সম্ভব নয়। এরই একটা প্রতিফলন নয় কী দারিদ্র্যের চিত্র? ২০১৬ সালের খানা জরিপের তথ্যানুসারে দেশের দরিদ্রতম অঞ্চল হচ্ছে কুড়িগ্রাম। বৃহত্তর রংপুরের কুড়িগ্রাম। এই জেলায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা হচ্ছে ৩১ হাজারের বেশি। কার্ডধারী প্রতিবন্ধীই হচ্ছে ৩০ হাজার ৮৯১ জন। কী মারাত্মক তথ্য তাই নয় কি? এই জেলার মানুষের কোন আয়-উন্নতি নেই। স্বাধীনতার পর থেকে ওই জেলা থেকে কত সংসদ সদস্য এলেন এবং গেলেন, কত মন্ত্রী বৃহত্তর রংপুর থেকে এলেন এবং গেলেন, এতে কী লাভ হয়েছে ওই অঞ্চলের। ভাবা যায় দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য লাভের পরও ৭১ শতাংশ লোক ওই জেলার দারিদ্র্য সীমার নিচে। শুধু ওই জেলাই নয়, বাড়ির কাছের কিশোরগঞ্জ এবং লালমনিরহাট, দিনাজপুর ইত্যাদি জেলারও দারিদ্র্র্য সীমার নিচের লোক ৫০ শতাংশের ওপর। শুধু আমাদের দেশে নয়, প্রতিবেশী ভারতেও দেখা যায় একই ঘটনা ঘটছে। সেখানকার আম্বানি পরিবার এখন ভারতে নয়, এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী। তার বাড়িতে হেলিপ্যাড আছে। অথচ এই পরিবারের মূল ব্যক্তি ধীরুভাই আম্বানি কয় টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন? কত বছরের ব্যবধানে আজ তার পুত্র লাখো কোটি রুপির মালিক? কী মেধার গুণে এই উন্নতি? সমস্ত গুণের পরও একটি গুণ বড় ‘ক্ষমতার কাছের লোক’ তিনি। এই গুণে মোটামুটি দু’-এক ডজন লোকের হাতে ভারতের সম্পদ কেন্দ্রীভূত। একই চিত্র আমাদেরও। অথচ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সংগঠন বলছে বৈষম্য উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বহুবার বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলেছেন। আমাদের দেশের সরকারী নীতিনির্ধারকরাও তাই বলছেন। কিন্তু, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ফল? শেষ পর্যন্ত ওই বৃত্তেই ঘুরছি আমরা। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×