ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীতলপাটির বিশ্বস্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

শীতলপাটির বিশ্বস্বীকৃতি

জামদানি, বাউল গান, মঙ্গল শোভাযাত্রার পর এবার বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন করল বাংলাদেশের শীতলপাটি। ইতোপূর্বে বাংলার ইলিশ, রসগোল্লাহসহ পাটের জেনোম আবিষ্কারও বিশ্বস্বীকৃতির মর্যাদা পেয়েছে। বাদ যায়নি ভীষণ দর্শন রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং সুন্দরী রূপসী চিত্রা হরিণের বিচরণস্থল সুবৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনও। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বাংলার ঐতিহ্যবাহী সম্পদ শীতলপাটি। জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ শীতলপাটিকে ‘ইনট্যানজিবল হেরিটেজ’ হিসেবে বিবেচনার জন্য ইউনেস্কোর কাছে আবেদন করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় সংস্থাটির ইন্টারগবর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং ইনট্যানজিবল হেরিটেজ বা নির্বস্তুক ঐতিহ্য সুরক্ষায় আন্তঃসরকার কমিটির ত্রয়োদশ অধিবেশনে নিশ্চিত হয়েছে শীতলপাটির বিশ্বস্বীকৃতির বিষয়টি। এই ঐতিহাসিক ঘটনার উদযাপন উপলক্ষে বর্তমানে নানা ধরনের শীতলপাটির প্রদর্শনী চলছে জাতীয় জাদুঘরে। শীতলপাটি বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে বুনন হলেও এই সম্পদটি বিশেষভাবে ঐতিহ্যিক সম্পদে পরিণত ও সমৃদ্ধি লাভ করেছে সিলেট বা শ্রীহট্টে। সেখানে শীতলপাটির বিশেষ ধরনের উন্নতমানের বেত মুর্তা উৎপন্ন হয়। লোকমোটিফ বুননে পারদর্শী কারিগরও অপেক্ষাকৃত সুলভ, যারা পুরুষানুক্রমে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ছন্দের জাদুকর হিসেবে খ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘খাঁটি সোনা’ কবিতায় শীতলপাটিকে তুলনা করেছেন বাংলার মাটির সঙ্গে, যেখানে ¯িœগ্ধ শীতল শিহরণ ও স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে যায়। কথিত আছে, একদা শীতলপাটি স্থান পেয়েছিল রানী ভিক্টোরিয়ার রাজপ্রাসাদেও। ব্যবসা কিংবা পর্যটন সূত্রে ভারতবর্ষে আসা বিদেশীরা একসময় মসলিন, জামদানি, মসলা ইত্যাদির সঙ্গে নিয়ে যেতেন শীতলপাটিও। মুঘলদের অন্দরমহলেও মসলিনের পাশাপাশি শীতলপাটির বিশেষ কদর ছিল। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সেই শীতলপাটি এবার স্বীকৃতি পেল জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে। এই গৌরব অবশ্যই বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির। তবে স্বীকৃতির পাশাপাশি শীতলপাটি তৈরির জন্য এর কাঁচামাল উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। পাটি তৈরির প্রক্রিয়াটি শ্রমঘন ও সময়সাপেক্ষ। একে পরিচর্যা না করলে কোন লাভ হবে না। শীতলপাটির প্রাপ্যতা বৃদ্ধিসহ বিদেশে রফতানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এগিয়ে আসতে পারে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিরদিনের জন্য স্থান পেয়েছে বাংলার ইলিশ। এর আগে ঠাঁই হয়েছে ঐতিহ্যসম্মত জামদানি শাড়ির। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই দুটো পণ্য, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক অর্জন। প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতর সূত্রের খবর, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ইলিশ মাছের নাম নিবন্ধন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও বিশ্ব মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের (ডব্লিউআইপিআরও) যৌথ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় সব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে থাকে। তদানুসারে ইলিশ এখন বাংলাদেশের পণ্য। অনুরূপ জামদানি, শীতলপাটিও। তবে সবকিছু সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতা আবশ্যক। গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে, রাখছেও। সর্বস্তরের মানুষ যদি জাতীয় ঐতিহ্যিক সম্ভাবনাময় পণ্য জামদানি, ইলিশ, শীতলপাটি ইত্যাদির সুরক্ষা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন হয় তাহলেই এর উৎপাদন এবং প্রাপ্যতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হলো এসব নিজস্ব সম্পদ, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এর যত্ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারসহ সকলের।
×