ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে বীজতলা তৈরি

ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে হাওড়াঞ্চলের কৃষক

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে হাওড়াঞ্চলের কৃষক

নিজস্ব সংবাদদাতা, কিশোরগঞ্জ, ৬ ডিসেম্বর ॥ বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাওড়াঞ্চলের কৃষক, আর্থিক অভাব-অনটনসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা বাধাগ্রস্ত করছে তাদের জীবিকা আর চলার পথকে। তারপরও থেমে নেই হাওড়বাসীর জীবনযাত্রার সংগ্রাম। যেসব স্থানে একটু আধটু চর জেগেছে, সেখানেই চাষাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাষীরা। ভয়াল প্রকৃতির আগ্রাসন আর নিঠুর দারিদ্র্যের কষাঘাতের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষেতের ফসল-উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ আর স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াইয়ে নামছেন তারা। চলমান আমন মৌসুমের ধানও পোকা আর রোগবালাইয়ের কারণে তেমন ফসল ফলাতে না পারলেও আসন্ন বোরো মৌসুমকে ঘিরে নতুন জীবন সংগ্রামে নেমেছেন হাওড়ের চাষীরা। আর অন্যদিকে জেলেরাও ব্যস্ত সময় কাটাতে মাছ ধরতে খালে-বিলে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানা যায়, অকাল বন্যায় কয়েক দফায় ফসল হারিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলার হাওড়াবাসী। ফসলের মাঠ থেকে এখনও নেমে যায়নি সে পানি! ফলে বোরো ধান রোপণের লক্ষ্যে যে সময়টাতে বীজতলা তৈরি কিংবা বীজতলায় পরিপূর্ণ থাকার কথা, ঠিক সে সময়টাতে পানিবন্দী ক্ষেতে পড়ছে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস। তারপরও হাল ছাড়েননি তারা। যেসব স্থানে একটু আধটু ক্ষেতের চর জেগেছে, সেখানেই চাষাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষক। জীবনে একটু স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে দিন-রাত এক করে বীজতলা তৈরি করে চলেছেন ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানায়, গত এপ্রিল মাসের আকস্মিক আগাম বন্যায় হাওড়ের কাঁচা ও আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। জুলাইয়ের শেষ দিকে শুরু হয় ফের বন্যা। দীর্ঘমেয়াদী সে বন্যার পানি নামেনি এখনও। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি রয়েছে। ফলে গতবারের বোরোর পর চলতি আমন মৌসুমের তেমন বেশি ধানও ঘরে তুলতে পারেননি হাওড়ের চাষীরা। হাওড়বাসী বলছেন, এ অঞ্চলে দু’দফার বন্যায় ফসলের পাশাপাশি গৃহপালিত পশু-পাখি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, এমনকি হাওড়ের মাছ পর্যন্ত হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তারা। বর্তমান পরিস্থিতিতেও দেখা দিয়েছে আরও নানা ধরনের সঙ্কট। তারপরও থেমে নেই তারা। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা বা ঘুরে দাঁড়ানোর এ সংগ্রাম চলবেই। ইটনা উপজেলার বাদলা ইনিয়নের থানেরশ্বর গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী জানান, বন্যার পানিতে তার ২ একর জমির ফসল তলিয়ে গিয়েছিল। তারপর রাখার জায়গা ও খাদ্যের অভাবে গরু-ছাগল খুব কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি। তালিকায় নাম তুলতে না পারায় পাননি কোন সরকারী সাহায্য-সহযোগিতাও। একবেলা আধাবেলা খেয়ে, আবার কখনও না খেয়েও পরিবার নিয়ে দিন পাড়ি দিয়েছেন। ঘুরে দাঁড়াতে এবারও ধারদেনা করে নিজের ২ কাঠা জমিতে বোরোর বীজতলা তৈরি করছেন। রাইটুটি ইউনিয়নের রাজি গ্রামের কৃষক রাজমন সাহা বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও কৃষক সহায়তা না হয় নাই পেয়েছিলাম, অন্তত জেলে সহায়তা তো পেতে পারতাম। জেলে জনগোষ্ঠীরও মানুষ আমরা। কিন্তু কিছুই পেলাম না! তবে সরকার থেকে বীজ সহায়তা পেয়ে বীজতলা তৈরি করছেন বলে জানিয়েছেন কৃষক মনু মিয়া ও শাহজাহান মিয়া। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, বীজ সহায়তা পাওয়া নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের জটিলতা। কোন কোন জনপ্রতিনিধি সরকারী বীজ দিয়ে টাকা নিচ্ছেন। যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারা বীজ সহায়তা পাচ্ছেন না। নিকলী উপজেলার ছাতিরচর ইউনিয়নের কৃষক আগাখান ও রোপমিয়া বলেন, এভাবে চলতে থাকলে পরিবার নিয়ে আমরা না খেয়ে মারা যাব। বন্যায় সবই খাইল, বিনিময়ে কোন কোন নেতার পেট ভরল! তারপরও তাদের তাদের খিদা মেটে না। টিভি-পত্রিকা সবখানে দেখি, সরকার আমাদের সহযোগিতা কম করেনি। কিন্তু তাতে কি হবে? সহযোগিতা আমাদের হাতে পৌঁছানোর আগেই তো নেতাদের পেটে সবেই হজম হয়। নিকলী উপজেলার সদর ইউনিয়নের মাইঝহাটি গ্রামের আকবার আলী ও ফারুক মিয়া জানান, জীবিকার তাগিদে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে জাল বুনছেন তারা। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের দখলদারিত্বে মাছ ধরতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর সারা জেলায় মোট ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩০ মেট্রিক টন।
×