ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট গল্পে বড় সিনেমা

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

ছোট গল্পে বড় সিনেমা

একটি অল্প বয়সের সুন্দরী মেয়ে (ধনীর দুলালী) বাড়ি থেকে রাগ করে পালিয়ে ঢাকা চলে আসে। ঢাকায় এসে লঞ্চ ঘাটের কাছে একটি সস্তা হোটেলে ওঠে। হোটেলে ওঠার কিছু সময়ের মধ্যেই মেয়েটির ভাব হয়, আধাবোকা ধরনের হোটেলবয় যুবকের সঙ্গে। অপ্রীতিকর এক ঘটনা থেকে মেয়েটিকে বাঁচায় ছেলেটি। দ্বিতীয় দফা মেয়েটিকে নিয়ে পালায় হোটেলবয়। শহরের অদূরে একটি বস্তি এলাকায় অস্থায়ী সংসার পাতে এই দুই আগুন্তুক। সেখানে কিছু অবাস্তব সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে গল্পের ইতি ঘটে। সিনেমা ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ বাংলাদেশের পুলিশ রাজীব চৌধুরী সন্ত্রাস দমনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপায় কলকাতায়। ফ্লাশ ব্যাকে জানা যায় রাজীরের লেখাপড়া বড় হওয়া সবই কলকাতায়। তার প্রাক্তন প্রেমীকাও সেখানকার। পুলিশি এ্যাকশন, রাজনৈতিক টানা হেঁচরা দু’চারটে খুন। দেখতে দেখতে আড়াই ঘণ্টা! গল্পের নির্দিষ্ট কোন ভিশন নেই, অনেক ঘটনার মেকি ঝলকানি দেখতে দেখতে শেষ সিনেমা ‘নবাব’। অহঙ্কারী মেয়ে মায়া। প্রভাবশালী সুদ ব্যবসায়ী মায়ের দুলালী। সুদের টাকা এই অহঙ্কারী মেয়েকে দিয়ে দাপটের সঙ্গে আদায় করে মা। অবশ্য মা তাকে সেভাবেই তৈরি করেছে। এক সময় নিজের মধ্যে আত্মোপলব্ধি আসে। জানতে পারে যাকে সে মা বলে জানে, যার নির্দেশে সে মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ ও অত্যাচার করে সেই মহিলাই কিনা তার আসল মা নয়। নিজের প্রয়োজনে, অর্থসম্পদ রক্ষার কৌশলে তাকে দিনের পর দিন ব্যবহার করছে তার এই তথাকথিত মা! মায়া অনুতপ্ত! মুহূর্তেই চুরমার হয় তার অহঙ্কার! সঙ্গে আড়াই ঘণ্টার সিনেমা ‘অহঙ্কার’ । আমেরিকান রোমান্টিক গল্পের সিনেমা ‘লিপ ইয়ার’। সেই সিনেমার কপি পেস্ট হলো ২০১৭ সালের আলোচিত সিনোমা ‘প্রেমী ও প্রেমী’। শুধুমাত্র এশিয়ান বা দেশীয় কালচার মাথায় রেখে মূল সিনেমার কাহিনীর সঙ্গে একটু মারামারি একটু রোমান্টিক গান বিশেষভাবে যোগ হয়েছে যা স্বকীয়তার কোন বিশেষ পর্যায় পরে না। বাকিটা লিপ ইয়ারের প্লট। সত্যতা উদ্ঘাটনে সিনেমার নায়ক তার দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে এই সত্যটি স্বীকার করেছেন। এখন পর্যন্ত বলা যায়, এটা ছিল বছরের সব থেকে আলোচিত সিনেমা। দেশের সীমানা পেরিয়ে রীতিমতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল এই সিনেমার আলোচনা বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়ায়; কার্যত সিনেমার ফলাফল ইতোমধ্যে আমরা অনেকেই দেখেছি। এক ফোঁটা পানি দিয়ে বিশাল মরুভূমি যেমনিÑ সুজলা সুফলা করা সম্ভব নয়! তেমনি, ছোট্ট এক খ- কাহিনীকে কেন্দ্র করে বড়পর্দায় লম্বা গল্প দেখানোও সম্ভব নয়! সেটাই প্রমাণ হয়েছে সব যুগে সবকালে। সিনেমা ‘ডুব’ অতি আগ্রহে বলেন, আর ভাল সিনেমার আস্বাদেই বলেন যে, বা যারা এই চেতনায় ডুবেছেন তারাই ভেসে উঠেছেন! কারণ অনেকই বলেছেন আমরা চেয়েছি এই সিনোমার গল্পে ডুবে যেতে কিন্তু গল্প আমাদের ডুবতে দেয়নি ভাসিয়ে রেখেছে গল্পের সারফেসে! এত কথার প্রেক্ষিতে গল্পের প্লট একটু না বললেই নয়। জাভেদ হাসান নামক একজন চিত্র পরিচালক উঠতি এক অভিনেত্রীর মোহনীয় প্রলোভনে সারা দিতে গিয়ে পারিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। নিজের মেয়ে ছেলে এবং স্ত্রীর মনের আকাশ থেকে এই মনুষটি ছিটকে পড়ে। তিনি হয়ে যান দূরপরবাসী! অন্তরদ্বন্দ্বে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মানুষটির জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সিনেমার গল্প বা চিত্রনাট্যের বিষয়টা এমন না যে, কোন একখ- ঘটনাকে ওপর-নিচ কিংবা ডানে-বাঁয়ে টেনে লম্বা করা যায়। তবে এখনকার সময়ে এই প্রবণতা হর-হামেশাই চলছে! টুকরো টুকরো কাহিনী টেনে টেনে লম্বা করা হচ্ছে কিংবা লম্বা একটি মেন্দামারা কাহিনীর ভেতর তিন চারটে গান পেস্ট করে সিনেমা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে! আসলে যারা এসব নিয়ে কাজ করেন তারা সাধারণ দর্শকদের থেকেও চিন্তায়-বুদ্ধিতে সম্ভবত কাঁচা! যে কারণে বেশিরভাগ দর্শকই এখন আর তাদের ওই হাক ডাকে সাড়া দেন না। বিশেষ করে, চমৎকার গল্প, মৌলিক গল্প, সমসাময়িক জীবন বাস্তবতার গল্প এ সবে এখন আর তাদের ধরে না! কারণ বহুদিন ধরে এমন সব বিশেষণ যুক্ত কাথায় সাড়া দিয়ে কোন ফল তারা পায়নি। সুতরাং এসব বিশেষণ এখন বেশিরভাগ মানুষের মনে এক ধরনের ভ্রান্তি তৈরি করে। খুব বেশি দূরের কথা না বলি পঞ্চাশ দশকের বাংলা সিনেমার গল্পের কথাই বলা যাক। সেই সময় আমাদের এই ভুখ-ে কত না অজস্র সমস্যা। সদ্য স্বাধীন হওয়া এই বিশাল জনপদের শত লক্ষ মানুষ জীবন বাস্তবতার কষাঘাতে এক রকম নিপীড়িত। সেই সময়ের সিনেমা এবং এর গল্প ছিল আফিমের মতো মোহনীয়! অসংখ্য মানুষ জীবন থেকে ক্ষণিক মুক্তির মোহে সিনেমা হলে পালিয়ে যেতে! এসবের বিশেষ কারণ ছিল জনতা সিনেমা নামে পর্দায় যা দেখেছে তার বেশিরভাগই ছিল মনুষ্য জীবন থেকে কুড়িয়ে নেয়া বাস্তব অনুষঙ্গ। আসল কথা হলো সিনেমার গল্প ছিল সাহিত্যনির্ভর। গভীর চেতনা জাগানিয়া এবং মর্মস্পর্শী! চোখ বুঝে মনের দুয়ারে উকি মারার মতো। যে কারণে আমরা ডুবেছি সিনেমার পর্দা হয়ে হৃদয়ের অতলে! কালে কালে এই জীবন, সাহিত্য এবং শিল্প থেকে আমরা যত দূরে সরে গিয়েছি ততই চলচ্চিত্র শিল্প আমাদের ছেড়ে দূরে সরেছে! কাজেই গল্প চাইÑ জীবনের গল্প, সাহিত্যর গল্প মানুষকে মুগ্ধ করার মতো নির্দিষ্ট ভিশনের গল্প, বিভ্রান্তির নয়! এসবের সঙ্গে যথাযথ চিত্র ধারণের ওস্তাদি তো অবশ্যই! এই মতবাদের সঙ্গে বেশিরভাগ চিত্র পরিচালক, মতে এক হলেও কাজে পারেন না, পারলে গল্পের আদৌ এই হাল হয় না।
×