ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিস্তরঙ্গ নগরজীবনে একদিনের সোফিয়া হাওয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

নিস্তরঙ্গ নগরজীবনে একদিনের সোফিয়া হাওয়া

মারুফ রায়হান ॥ বিশেষ বাক্সে ‘প্রাণ-বিযুক্ত’ অবস্থায় উড়োজাহাজে চেপে ঢাকা এসেছিল সোফিয়া; রোবট গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এক রোবট। হংকংয়ে তৈরি (পড়ুন জন্ম নেয়া!) সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়েছে সৌদি আরব। কিছুদিন আগে ইউএনডিপি তাকে বিশ্বের প্রথম নন-হিউম্যান ইনোভেশন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা করে। মঙ্গলবার রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেলে দিনভর চলেছে তার অঙ্গ প্রতিস্থাপন (ইনস্টল)। বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেনের সঙ্গে নামের মিল থাকলেও এই রোবট-রমণীর মুখের আদলটি গড়া হয়েছে আরেক বিশ্বখ্যাত নায়িকা অড্রে হেপবার্নের রেখে। যদিও তার মাথায় কালো বা স্বর্ণালী কেশরাজির বদলে শোভা পাচ্ছে জটিল সব তার ও যন্ত্রাংশ। অড্রে হেপবার্নের নাম উচ্চারণমাত্র আমাদের অনেকেরই রোমান হলিডে সিনেমা দেখার কথা মনে পড়ে যাবে। ভদ্র মহিলা শেষ বয়সে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়ে ঢাকায়ও এসেছিলেন। আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। থাক সে কথা। তার স্মৃতি মনে পড়ল যে অভিনব যন্ত্রের কল্যাণে, সেই সোফিয়াতেই ফেরা যাক, যার মুখে কিছু অভিব্যক্তিও ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। সোফিয়াকে ‘যন্ত্র’ বলছি বটে, যদিও কোথাও দ্বিধার কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে। সোফিয়াকে আমরা, ভাবাবেগে ভরপুর বাঙালীরা, ইতোমধ্যেই প্রায় বিদেশিনীর মর্যাদা দিয়ে ফেলেছি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সোফিয়াকে সৌজন্যমূলক (কমপ্লিমেন্টারি) ‘গোল্ড মেম্বারশিপ’ দেয়া হচ্ছে। কোন যাত্রী বছরে ৭৫ হাজার মাইল আকাশপথে ভ্রমণ করলে এই সুবিধা পায়। সংবাদকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে কে সোফিয়ার সঙ্গে আগে কথা বলবে। এক হৃদয়হীনাকে ঘিরে আমাদের অনেকেরই চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেছে। মানতেই হবে, ধোঁয়া-ধূলি-কংক্রিটের জঙ্গল এই ঢাকায় নিত্যদিনের যানজটের বিপন্নতাকে পেছনে ফেলে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে ওই রোবটিনী। বলতে পারি, নগরীতে এক ধরনের আনন্দধারাই বইয়ে দিয়েছে সোফিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত কথামালা। হোক না তা ভিন ভাষায়, মাতৃভাষা বাংলায় নয়। অবশ্য সোফিয়া চেষ্টা করছে ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি ‘কণ্ঠে’ ফুটিয়ে তুলতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিদীপ্ত সোফিয়ার অভিমত জানতে চাওয়া হলে সে চমৎকারভাবে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায় এভাবেÑ ‘পৃথিবীতে কথা বলার মতো আরো বহু বিষয় আছে।’ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবেও সোফিয়া দারুণ সপ্রতিভতার পরিচয় দিয়েছে। শেখ হাসিনা তাকে প্রশ্ন করেনÑ ‘হ্যালো সোফিয়া কেমন আছো?’ সোফিয়া উত্তরে বলেÑ‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি ভাল আছি। আমি গর্বিত। আপনার সঙ্গে সাক্ষাত হওয়া দারুণ ব্যাপার।’ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেনÑ‘তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে?’ এবারের উত্তরটি আরও স্মার্ট। সোফিয়া বলল, ‘আমি জানি, আপনি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। আপনি মাদার অব হিউম্যানিটি। আপনার নাতনির নামও সোফিয়া।’ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার থেকে হৃদয়হীন যন্ত্রমানবীকে জনসমক্ষে এনেছে মানবসমাজ নিজেরই প্রয়োজনে। তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে কৌতূহল। যে কোন প্রশ্নের লাগসই জবাবদানে দক্ষ সোফিয়া নামের নারীসদৃশ যন্ত্র নিয়ে আমাদের আলোচনা ও আলাপের আরেকটি মানেও রয়েছে। সেটি হলো বিজ্ঞানমুখিতা এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবন থেকে সুবিধা নেয়ার ভাবনা। একেকটি যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছে আর মানুষের কাজে দারুণ গতি চলে এসেছে। অন্যভাবে দেখলে জানব, একেকটি যন্ত্র আসছে আর কর্মহীন হয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক মানুষ। দেখতে শুনতে মানুষেরই মতো রোবট এসেও একই পরিস্থিতি তৈরি করছে। ম্যাককেনজি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ কোটি চাকরি যাবে রোবটের হাতে। সোফিয়ার ‘স্বজাতি’ ও ‘সতীর্থদের’ আগমনে ভবিষ্যতে পৃথিবীর চেহারা কীভাবে বদলে যাবে সেটি এই মুহূর্তে আমরা ভাবতে চাইছি না। বরং আরেকটু উল্লাস করা যাক সোফিয়া নামের এক যন্ত্রমানবীর ঢাকা আগমনের ফলে নিস্তরঙ্গ একটি শহরে কিছুটা তোলপাড় ওঠার জন্যে। বুধবার (গতকাল) রাতেই তার বিদায় নেবার কথা; তার অনিবার্য প্রস্থানে আমাদের মধ্যে কিছুটা বিষণ্নতাও নেমে আসতে পারে বৈকি। তবু তাকে আমরা বলতে চাইব, বিদায় সোফিয়া, যাত্রা শুভ হোক।
×