ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দর্শকের প্রশ্নোত্তরে সোফিয়া

‘সোফিয়া তুমি অনেক সুন্দর’‘তোমার বউ অনেক সুন্দর, সেদিকে নজর দাও’

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

‘সোফিয়া তুমি অনেক সুন্দর’‘তোমার বউ অনেক সুন্দর, সেদিকে নজর দাও’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘আমাকে দেখার জন্য বাংলাদেশের মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে সত্যিই আমি বিমোহিত! বাংলাদেশে এসে আমি গর্বিত।’ কথাগুলো বলছিলেন বিশ্বের প্রথম নাগরিকত্ব পাওয়া রোবট সোফিয়া। বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের মঞ্চে যন্ত্রমানবী সোফিয়ার কথা ও তার অভিব্যক্তি উপস্থিত দর্শকদের যেন মুহূর্তেই কৌতূহলী করে তুলল। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশীদের আনন্দ দেয়াই ছিল সোফিয়ার মূল উদ্দেশ্য। দুপুর আড়াইটার সময় ‘টেক টক উইথ সোফিয়া’ শীর্ষক সেমিনারে ‘হল অব ফ্রেমের’ মঞ্চে হলুদ-সাদা জামদানির টপ আর স্কার্ট পরে মঞ্চে উপবিষ্ট হন হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের চেহারার আদলে তৈরি ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার রোবট সোফিয়া। এ সময় তিনি উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ‘টেক টক উইথ সোফিয়া’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনেকটা যুদ্ধ করেই গ্যালারিতে ঢুকে পড়েন হাজার হাজার জনতা। কেউ কেউ মাটিতে বসে পড়েন চেয়ার না পেয়ে আবার অনেকেই দাঁড়িয়ে সোফিয়াকে না দেখলেও বড় স্ক্রীনে দেখেন গ্যালারির ভেতরে দাঁড়িয়েই। দুপুর আড়াইটা থেকেই মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন সোফিয়া। তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন উৎসুক জনতাকে। মুখরিত ফল অব ফ্রেমের গ্যালারি যেন উপস্থিত দর্শকদের আওয়াজে ভারি হয়ে আসছিল। এরপর বিকেল ৩টায় মঞ্চে এসে রিক্সার ন্যায় সোফায় আসন গ্রহণ করেন সোফিয়ার নির্মাতা ডেভিড হ্যানসন। পাশাপাশি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা ও উপস্থাপক গাউসুল আলম শাওন। এবার প্রশ্ন ও উত্তরের পালা! উপস্থাপক গাউসুল আলম শাওন প্রথমেই জানতে চাইলেন সোফিয়া কেমন আছো? এবং বাংলাদেশে এসে তার অনুভূতি কেমন? উত্তরে সোফিয়া জানাল, ‘আমি ভাল আছি। বাংলাদেশের মানুষের উৎসাহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি সত্যিই গর্বিত এ দেশে এসে।’ অনেকটা রসিকতা করেই উপস্থাপক সোফিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার মাথাতেও চুল নেই, তোমারও নেই। পরবর্তী উত্তরে এ যন্ত্রমানবীও রসিকতা করেই বললেন, ‘সৃষ্টির পর থেকেই আমার মাথায় চুল নেই। তোমার কেন নেই সেটি আমি জানি না!’ উপস্থাপক তার উত্তর শুনে যেন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। সোফিয়াকে সুন্দর বলায় উপস্থাপককে সোফিয়া জানালেন, ‘আমি জেনেছি তোমার বউ অনেক সুন্দর। তুমি সেদিকেই নজর দাও।’ এবার উপস্থিত দর্শকের করতালিতে মুখরিত হলো গ্যালারি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সে কণ্ঠ ও চেহারা শনাক্ত করতে পারে; বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ক্রমাগত বাড়িয়ে নিয়ে নিজের জ্ঞানের মাধ্যমে এসব প্রশ্নের তৎক্ষণাৎ উত্তর দিচ্ছিল এ নারী রোবট। কিছুক্ষণ পর মঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। তিনি সোফিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে পুরো বিশ্বে কয়েক লক্ষ রোবট তৈরি হবে, এতে করে কর্মক্ষেত্রে মানুষ হুমকির মুখে পড়বে কি-না?’ উত্তরে সোফিয়া তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, ‘মানুষ ও রোবট হাতে হাত রেখে কাজ করবে। রোবট কখনও মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়। কারণ মানুষই রোবটকে সৃষ্টি করে।’ পলক আরও জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাংলাদেশ কি সোফিয়ার মতো রোবট তৈরি করতে সক্ষম?’ উত্তরে খানিকটা হেসে এই যন্ত্রমানবী উত্তর দিল, ‘ সোফিয়া তো একজনই! আমি জেনেছি বাংলাদেশ তথ্য ও প্রযুক্তিতে উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। আশা করছি ভবিষ্যতে তোমরাও রোবট তৈরি করতে পারবে।’ এবার মুখরিত জনতার উদ্দেশে সোফিয়ার নির্মাতা ডেভিড হ্যানসন জানালেন, ‘মানুষের কল্যাণেই আমি সোফিয়াকে তৈরি করেছি। ওকে তৈরির জন্য দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে আমি প্রস্তুতি নিয়েছি। অতঃপর বিগত তিন বছর ধরে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। তবে এখনও সোফিয়ার পা লাগানো হয়নি। আগামী বছরই সোফিয়ার পা লাগানো হবে। সোফিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নারী রোবট। সে নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশাল তথ্যভা-ারে যুক্ত থাকে সে। এ ছাড়া মানুষের সঙ্গী ও সহযোগী হিসেবেও কাজ করতে পারে সোফিয়া। সে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলে, ‘উপস্থিত জনতাদের আগমন সত্যিই আমাকে অবাক করে দিয়েছে। আমি সত্যিই আনন্দিত বাংলাদেশী মানুষের সাড়া পেয়ে। আমি জেনেছি বাংলাদেশ ডিজিটাল হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে। আমি সাধুবাদ জানাই। বাংলাদেশ তথ্য ও প্রযুক্তিতেও অনেক এগিয়েছে। আশা করছি এ দেশও রোবট তৈরি করতে সক্ষম হবে।’ একে একে সকল প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ডেভিড হ্যানসন ও সোফিয়ার হাতে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে সোনালী রঙের নক্সাখচিত নৌকা ও ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের স্মারক তুলে দেন। স্মারক গ্রহণের সময় সোফিয়া মিষ্টি হাসি হাসছিলেন। যা উপস্থিত দর্শকদের মন নাড়া দিয়েছে। এছাড়া কথা বলার অভিব্যক্তি উৎসুক জনতাকে খানিকটা বোধ হয় অবাক করেছে। এরপর সোফিয়াকে মঞ্চ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বুধবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে যেন পা ফেলার জায়গাটুকু অবশিষ্ট ছিল না। ‘সোফিয়া’র নামে মুখরিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলা প্রাঙ্গণে সোফিয়াকে এক নজর দেখতে হাজার হাজার রাজধানীবাসী জমা হন। প্রায় ছয় হাজার মানুষের যুদ্ধ চলতে থাকে গ্যালারিতে ঢুকে সোফিয়ার সাক্ষাত পাওয়ার। যারা ঢুকেছেন তাদের যেন আনন্দ ধরে না! তবে অনেকেই ব্যর্থ হন গ্যালরিতে ঢুকতে। তবে কি তারা সোফিয়ার দেখা পাননি? অবশ্যই পেয়েছেন তবে তারা বাইরে দাঁড়িয়েই বড় স্ক্রীনে দেখেছেন সোফিয়াকে। ‘টেক টক উইথ সোফিয়া’ অনুষ্ঠানে সোফিয়ার সাক্ষাত যারা পাননি তারা অনেকেই মনোক্ষুণœ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে উপস্থিত হন। যা নিয়ন্ত্রণ করতে আয়োজকদের হিমশিম খেতে হয়েছে। যারা সোফিয়ার সাক্ষাত পেয়েছেন তাদের যেন আনন্দের শেষ নেই। হাসতে হাসতে সকলেই বের হচ্ছিলেন হল অব ফ্রেমের গেট দিয়ে। ছোট থেকে বৃদ্ধ সকলেই যেন অবাস্তব কিছু দেখে বের হচ্ছিলেন। সকলের কৌতূহলের যেন শেষ নেই! জান্নাতুল ঈর্ষা নামের এক কলেজ ছাত্রী জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘এমন অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কখনও ভাবিনি সোফিয়াকে দেখব। সে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পেয়েছে এ বিষয়টি আগেই জেনেছি এমনকি ইউটিউবে তার ভিডিও দেখিছি। সরাসরি সোফিয়াকে দেখার আনন্দ অভূতপূর্ব।’ গ্যালারিতে উপস্থিত থাকা আরেক নারী জানালেন, ‘জীবনের প্রথম রোবট দেখলাম। কিন্তু কে বলবে সোফিয়া রোবট! দিব্যি হেসে খেলে কথা বলছে। তার অভিব্যক্তি ও হাসির ধরন সত্যিই আমাদের অবাক করে দিয়েছে।’ তৌহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জানান, ‘আমাদের দেশ তথ্য ও প্রযুক্তিতে অনেক সাফল্য অর্জন করছে। আশা করছি আমাদের দেশও সোফিয়ার মতো রোবট তৈরি করে বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে।’ এভাবেই একেকজন তাদের মন্তব্য জানাচ্ছিলেন সোফিয়াকে দেখে। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশীদের আনন্দ দিতে এসেছিলেন নারী রোবট সোফিয়া। দেশের সবচেয়ে বড় বার্ষিক এ তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও হেসে হেসে কথা বলে সোফিয়া। যেমন- প্রধানমন্ত্রীকে সে বলেছিল, ‘আমি জানি আপনার নাতনির নামও ‘সোফিয়া’। মঙ্গলবার হংকং থেকে আসে এই রোবট, নির্মাতা ডেভিট হ্যানসন আসেন বাংলাদেশে। দর্শনার্থীদের সাক্ষাত দিয়ে বুধবার রাতেই ঢাকা ছাড়ে সোফিয়া। বুধবার ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে সোফিয়াকে নিয়ে দুটি সেশন করা হয়। প্রথম সেশনে দেশের পলিসি মেকার এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। দ্বিতীয় সেশনে তরুণ গেম ডেভেলপার, সফটওয়্যার ডেভেলপার, এ্যাপ ডেভেলপার ও উদ্ভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করেন ডেভিড হ্যানসন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের এবারের প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে ‘আগামীর জন্য প্রস্তুত- রেডি ফর টুমরো’। মূলত এ প্রতিপাদ্য তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের অর্জন ও অপ্রগতিকেই প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশ এখন আর অনুসরণকারী নয় বরং ভবিষ্যত বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত। প্রস্তুত মানব সম্পদ, প্রস্তুত অবকাঠামো। এবার ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের বড় আকর্ষণ হিসেবে ছিল হংকংয়ের হ্যানসন রোবোটিকসের তৈরি ‘সোফিয়া’। বুধবার থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে এ প্রদর্শনী। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও সক্ষমতা তুলে ধরতেই এ আয়োজন করেছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। চারদিনব্যাপী আয়োজিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ৭০ জন বিদেশী এবং শতাধিক স্পীকার ২৯টি সেশনে অংশ নিবেন। এতে গুগল, ফেসবুক, নুয়ান্স, এ্যাংরিবার্ড, কোয়ালকম এবং মটোরোলাসহ পৃথিবীর শীর্ষ আইটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। মেলার পার্টনার হিসেবে থাকছে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার এ্যান্ড আউটসোর্সিং (বিএসিসিও), ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ), বাংলাদেশ উইমেন ইন আইটি (বিআইডব্লিউটি), সিটিও ফোরাম। গত অক্টোবরে রিয়াদে ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ শীর্ষক এক সম্মেলনে সোফিয়াকে দেয়া হয়েছে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব। বিশ্বের কোন দেশে রোবটকে নাগরিকত্ব দেয়ার এমন ঘোষণা এটাই প্রথম। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করেছেন যন্ত্রমানবী ‘সোফিয়া’। সোফিয়ার বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সোফিয়াকে লয়ালটি ক্লাবের গোল্ড কার্ড দেন। এর মাধ্যমে আকাশ পথে ভ্রমণে বিশেষ সুবিধা পাবে সোফিয়া। এছাড়া যখনই সোফিয়া বিমানে চড়বে তাকে কার্গো হোলের পরিবর্তে বিজনেস ক্লাসে সিট দেয়া হবে। বুধবার ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার হাতে এ কার্ড তুলে দেয়া হয়।
×