ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

পুতিন কি গণঅভ্যুত্থানের ভয় করছেন

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

পুতিন কি গণঅভ্যুত্থানের ভয় করছেন

এখনকার বিশ্বে অন্যতম শক্তিমান রাষ্ট্রনায়ক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার হাবভাব দেখে মনে হতে পারে তার মধ্যে পিটার দি গ্রেট ও জোসেফ স্ট্যালিনের মিশ্রণ রয়েছে। সন্দেহ নেই যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়া যে বিপর্যয়ের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল তা থেকে তিনি দেশকে আবার মর্যাদাপূর্ণ আসনে টেনে তুলেছেন। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে তিনি শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও প্রভাবের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছেন। কিন্তু তার সাফল্যের উল্টোদিকে ব্যর্থতাও কম নয় যার কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ধুমায়িত হচ্ছে। কি সেই ব্যর্থতা? অর্থনীতি দিয়েই শুরু করা যাক। তেলের দর পড়ে যাওয়া এবং ২০১৪ সালে পাশ্চাত্যের আরোপিত অবরোধের কারণে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ধর্মঘট বেআইনী করা হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ করেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং ক্ষণিকের জন্য ধর্মঘট হচ্ছে। এটা সুগভীর শ্রমিক অসন্তোষের লক্ষণ। এদিকে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি ও বেতন আটকে রাখা হচ্ছে কখনও কখনও মাস মাস দরে। কর্মস্থলে কর্তব্যরত অবস্থায় কারোর মৃৃত্যু হলে তার পরিবারকে আগে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখন তা দেয়া হচ্ছে না। ওদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার প্ররোচিত ও সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহে এখন অচলবস্থা বিরাজ করছে। এই বিদ্রোহ জারি রাখার জন্য রাশিয়াকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রুশ হস্তক্ষেপের ফলে বাশার সরকার পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বটে, তবে তাতে রাশিয়ার কতটুকু লাভ হয়েছে সেই প্রশ্ন বড় করে দেখা দিয়েছে। বরং এই যুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় তা বৃহত্তর রূপ ধারণ করতে পারে। সেই বৃহত্তর যুদ্ধের চাপ রাশিয়ার অর্থনীতি সইতে পারবে কিনা সেটাও প্রশ্ন। জনমত জরিপে দেখা যায় পুতিনের জনমর্থন আশি শতাংশের ওপর। তাহলে তার উদ্বিগ্নবোধ করার কোন কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু তার পরও পুতিন উদ্বিগ্ন এবং বেশ গভীরভাবেই উদ্বিগ্ন এর প্রমাণ ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে রাশান ন্যাশনাল গার্ড নামে একটি এলিট অভ্যন্তরীণ বাহিনী গঠন। এর সৈন্য সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ এবং এই বাহিনী কেবল পুতিনের প্রতি অনুগত। এই বাহিনীর নেতৃত্ব যে জেনারেলের হাতে তিনি বহু বছর ধরে পুতিনের বিশেষ দেহরক্ষী ছিলেন। নিজের সৈন্যদের কোথাও নিয়োজিত করতে চাইলে এই জেনারেলের পুতিন ছাড়া অন্য আর কারোর অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন নেই, বাধ্যবাধকতাও নেই। পার্লামেন্টের নয়, প্রতিষ্ঠিত সামিরক বাহিনীর নয়, অন্য কারোর নয়। এই জেনারেল ও তার বাহিনী এক স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ করে। পুতিনের এমন এক শক্তিশালী রক্ষীবাহিনীর কেন প্রয়োজন হলো? তার তো আগে থেকেই এক শক্তিশালী অত্যাধুনিক ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী আছে। তাহলে এমন বাহিনীর কেন প্রয়োজন? পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, জনমত জরিপের ফল যাই হোক না কেন, নিজের জনগণকে নিয়ে পুতিনের এক সুগভীর ভীতি রয়েছে। তার আশঙ্কা একদিন তারা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে যেমন তারা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এক শ’ বছর আগে ১৯১৭ সালের সাত নবেম্বর তারিখে। এমন গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কা তার আত্মজৈবনিক কাহিনীতেও আছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে পুতিন ড্রেসডেনে কেজিবির অফিসার ছিলেন। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর ক্রুদ্ধ জার্মানদের এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা তার সদর দফতরে হামলা চালায়। সরকারী কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলার মরিয়া চেষ্টা চালানোর সময় পুতিন মস্কোর নির্দেশের জন্য টেলিফোন করেছিলেন। কেউ তার টেলিফোনে সাড়া দেয়নি। তখনই তিনি ঠিক করেছিলেন কখনই আর কারোর ওপর নির্ভর করে থাকবেন না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পুতিন অন্যান্য দেশের গণঅভ্যুত্থান দেখেছেন। ইউক্রেনের ২০০৪ সালের গণঅভ্যুত্থান তাকে আতঙ্কিত করেছিল। সে সময় তিনি সেটা দমন করতে অসমর্থ ছিলেন। ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় ঘটেছিল গণবিস্ফোরণ। তখন তিনি সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তা দমন করেছিলেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আবার গণঅভ্যুত্থান হয়। পুতিন উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন এই ভেবে যে, ইউক্রেনবাসীর স্বাধীনতার আস্বাদ রুশ জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি সামরিক পথে অগ্রসর হন এবং ক্রিমিয়া দখল করে নেন। এর অল্পদিন পরই তিনি দক্ষিণ ইউক্রেনে সামরিক বাহিনী পাঠান। সেখানে এখনও অসন্তোষ ধুমায়িত অবস্থায় রয়েছে। পুতিন বিশ্ব মঞ্চে সদর্পে পদচারণা করে বেড়াতে পারেন। কিন্তু নিজের যে বিশেষ রক্ষীবাহিনী গঠন করেছেন তা থেকে তার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘস্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। জার দ্বিতীয় নিকোলাসেরও এমন রক্ষীবাহিনী ছিল যার নাম ওখরানা। সেই বাহিনী ১৯১৭ সাল পর্যন্ত জারকে রক্ষা করতে পেরেছিল। এরপর রুশ জনগণ বলেছিল যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এই কথাগুলো পুতিন শীঘ্রই শুনতে চান না। সূত্র : টাইম
×