ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

একজন বাঁশিওয়ালার গল্প...

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

একজন বাঁশিওয়ালার গল্প...

*আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব কম হলেও দেশী-বিদেশী সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার খেলায় বাঁশি বাজিয়েছেন ফুটবলের তারকা রেফারি আজাদ রহমান ্র এক সময়ের দেশের শীর্ষস্থানীয় দল মোহামেডান বনাম আবাহনীর ১২টি ম্যাচ মাঠ থেকে পরিচালনা করেছেন তিনি ্র বাঁশির অনেক প্রকার ভেদ আছে ্র তিনি জানান ক্যারিয়ারের শুরুতে ফক্স-ফরটি ব্র্যান্ডের বাঁশি ব্যবহার করেছেন * শেষ করেছেন একমি ব্র্যান্ড দিয়ে ্র ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৬টি বাঁশি ব্যবহার করেছেন ্র প্রথম মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে বাঁশি বাজানোর স্মৃতি মনে আছে? হ্যাঁ মনে আছে *সেটা মিরপুর স্টেডিয়ামে *তখনও মাঠে প্রচুর দর্শক হতো ্র আমি দর্শক দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম *পরে আস্তে আস্তে নিজেকে মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নেই টেস্ট পরীক্ষায় অঙ্ক খারাপ হয়েছিল। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল নিজাম উদ্দিন এ কারণে এসএসসি পরীক্ষার মূলপর্বে অংশ নিতে দেবেন না কিছুতেই। অনেক অনুনয় বিনয় করে মূল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অনুমতি পান। অবশেষে অঙ্কে লেটার মার্কস নিয়েই এসএসসি পাস করেন। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল আদর করে পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন তোর এই জিদ তোকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। কতদূর যেতে পেরেছেন সে প্রশ্ন নয় তবে কর্ম ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে সৎ বলিষ্ঠ এবং কর্মক্ষম ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর ও ঢাকা ফুটবলের জনপ্রিয় রেফারি আজাদ রহমান। বাংলাদেশের তারকা এই রেফারি সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। আর বাঁশি হাতে দেখা যাবে না তাকে সবুজ গালিচায়। মোহামেডান-ব্রাদার্স ম্যাচের মধ্য দিয়ে তিনি রেফারিং থেকে অবসর নেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ রহমান অবসর নেন দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যকার ম্যাচে। ওই ম্যাচে মাঠে বাঁশি না বাজালেও টস করেছিলেন। আজাদ রহমানের জন্ম ঢাকার কুর্মিটোলায় ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে। ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল খুব বেশি। তবে ফুটবলটাই তাকে বেশি টানতো। খেলাধুলার কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ কম হওয়াই বাবা একদিন বলেন খেলাধুলা করলে খেলাধুলা না হয় পড়াশোনা । সেই থেকে খেলাধুলার প্রতি নেশা কমিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হন আজাদ রহমান। তথাপি তাকে মাঠ যেন খুব ডাকত। এত কিছু থাকতে ফুটবলের বাঁশির প্রতি কিভাবে কিভাবে আকৃষ্ট হলেন? এই প্রশ্নের জবাবে আজাদ বলেন, নাটকীয়ভাবে। সেটা ২০০০ সাল। আমি সবে মাত্র ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোগদান করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃবিভাগীয় বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার একটি খেলা পরিচালনা করি আমি। খেলা শেষ করার পর তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর আব্দুল খালেক আমাকে বাহাবা দিয়ে জানালেন তুমি ফুটবলে বাঁশি বাজালে আর ভাল করবে। ব্যাস সেই থেকে আমি ঢাকার ফুটবলের বাঁশি বাজিয়ে ম্যাচ পরিচালনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আজাদ রহমানের সেই স্বপ্নপূরণ হয় ২০০১ সালে। ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃফুটবল প্রতিযোগিতার খেলা পরিচালনা করেন। মাঠে বাঁশি বাজানো দেখে তার সিনিওর কলিগরা ফেডারেশনের তখনকার ডেপুটি চেয়ারম্যান মরহুম মনিরুল ইসলাম স্যারকে আজাদ রহমানের কথা বলেন। উনি তাকে ফেডারেশনে ডাকেন এবং পরদিন মাতুয়াইল আর আদমজীর মধ্যেকার তৃতীয় বিভাগের একটি খেলা পরিচালনা করার কথা বললে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান। ঘটনা বহুল সে ম্যাচ পরিচালনা করতে নেমেই দুই দলের চারজন খেলোয়াড় কে লাল কার্ড দেখান। উপস্থিত দর্শক এবং ম্যাচ পরিচালনা কমিটি যা দেখে বলেছিলেন সিদ্ধান্ত সঠিক। মনিরুল ইসলাম দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন এমন রেফারি আমার দরকার। সেই থেকে শুরু আর থেমে থাকেননি। তবে শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরণ করেন আব্দুল খালেকের কথা। এই আব্দুল খালেকই তাকে ফুটবলের বাঁশির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে পথ দেখান। ১৯৮০-৯০ দশকে বাংলাদেশ ফুটবলে মোহামেডান বা আবাহনী সমর্থন করেন না এমন কেউ ছিল না। আপনার যেহেতু খেলাধুলার নেশা ছিল আপনিও নিশ্চয় কোন এক দলকে সমর্থন করতেন? তাতে এই দুই দলের ম্যাচে আপনার রেফারী হিসেবে ম্যাচ পরিচালনায় কোন প্রভাব পড়তো কি না। জবাবে আজাদ রহমান হাসতে হাসতে জানান আমি ছোট বেলা থেকে আবাহনীর সমর্থক ছিলাম। অথচ দুই দলের ম্যাচ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমি থাকতাম নিরপেক্ষ বিচারকের আসনে। আমার জানা মতে আমার দ্বারা কোন দল অন্যায়ের শিকার হয়নি। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আবাহনীর খেলোয়াড় যদি কোন গোল মিস করত তাহলে কি খারাপ লাগতো? আবারও হাসি দিয়ে জানান সেটা আবাহনীর ক্ষেত্রে নয় মাঠে কোন খেলোয়াড় ভুল পাশ কিংবা নিশ্চিত গোল মিস করলে আমি তাকে শুধরে দিতে চেষ্টা করি। এই তো সেদিন মোহামেডানের খেলায় মোহামেডানের এক খেলোয়াড় ডি বক্সের অনেক বাইরে থেকে বল সরাসরি গোলে মালে যা অনেক উপর দিয়ে যায় অথচ তার এক সতীর্থ খেলোয়াড় ডি বক্সের খুব কাছাকাছি ছিল । সে তাকে মাইনাস করতে পারতো এবং সেখান থেকে গোলও হতে পারত। আমি খুবই হতবাক হয়েছি। অবশেষে আমি অনেকটা ক্ষোভেই তাকে বলি এইটা কি করলা? আবার মোহামেডান আবাহনীর এক ম্যাচে মূল রেফারী ছিলেন মনসুর আজাদ ভাই। আমি ছিলাম সহকারী রেফারি। মোহামেডান একটা গোল করলে আমি তা পতাকা উঁচিয়ে বাতিল করি। পরে ভিডিওতে প্রমাণ মিলেছিল আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। মাঠের বাইরে থেকে আজাদ রহমান বাংলাদেশ ফুটবলের ক্রেজ দেখেছেন। দেখেছেন উত্থান কিন্তু যখন রেফারি হিসেবে মাঠে ছিলেন তখন ফুটবলের চরম দৈন্য দশা। ফুটবলের পড়ন্ত বিকেলে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন দেহসের এই জনপ্রিয় খেলাকে। ফুটবলের কেন এই হাল? আসল দুর্বলতা কোথায় বলে মনে হয়েছে আপনার? তিনি বলেন মূল সমস্যা প্লানিং এ। যদি আপনাকে ফুটবলের কোন এক গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে কি কি পদক্ষেপ নিবেন? তিনি সহাস্যে জানান প্রথমে প্রতি জেলায় লীগ চালুর ব্যবস্থা করবো। এজ ভিত্তিক দল গঠন করে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা দেবার চেষ্টা করব। সকল সংগঠক এবং সাবেক খেলোয়াড়দের সঙ্গে এক টেবিলে বসে উনাদের কাছ থেকে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করব এবং উনাদেরকে দিয়েই সমাধানের পথ বের করব। দেশীয় কোচদের প্রধান্য দিব। আমার বিশ্বাস নতুন পুরনো সবাই যদি ফুটবলের সঙ্গে কাজ করে তবে ফুটবল নিঃসন্দেহে খুব শিগগিরই এগিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব কম হলেও দেশী-বিদেশী সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার খেলায় বাঁশি বাজিয়েছেন। এক সময়ের দেশের শীর্ষস্থানীয় দল মোহামেডান বনাম আবাহনীর ১২টি ম্যাচ মাঠ থেকে পরিচালনা করেছেন তিনি। বাঁশির অনেক প্রকার ভেদ আছে। তিনি জানান ক্যারিয়ারের শুরুতে ফক্স-ফরটি ব্র্যান্ডের বাঁশি ব্যবহার করেছেন। শেষ করেছেন একমি ব্র্যান্ড দিয়ে। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৬টি বাঁশি ব্যবহার করেছেন। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রয়াত রেফারি মনিরুল ইসলাম ভাইয়ের কথা। তিনি জানান, ডাবল নোজের একমি ব্র্যান্ডের বাঁশিটি মনির ভাই তাকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রথম মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে বাঁশি বাজানোর স্মৃতি মনে আছে? ‘হ্যাঁ মনে আছে। সেটা মিরপুর স্টেডিয়ামে। তখনও মাঠে প্রচুর দর্শক হতো। আমি দর্শক দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে আস্তে আস্তে নিজেকে মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নেই। সেই ম্যাচটি গোল শূন্য ড্র হয়।’ যেদিন বড় কোন খেলায় বাঁশি বাজানোর দায়িত্ব থাকত সেদিন কি মা খুব চিন্তা করতেন? জোরে অট্ট হাসি দিয়ে বলে সে এক মজার কাহিনী। আমি সব সময় মাঠে যাবার আগে মাকে বলে যেতাম আবার এসেও বলতাম। মোহামেডান-আবাহনীর খেলায় প্রথম যেদিন আমি বাঁশি হাতে নেই সেদিন মাকে বললাম মা আজ ভাল করে দোয়া করবে। মা সারা বেলা খুব টেনশনে ছিলেন। রাতে বাসায় এসে মাকে বলি মা আজ খুব সুন্দরভাবে খেলা শেষ করেছি। মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন খোকন (আজাদ রহমানের ডাক নাম) তুই কি খেলায় আজ জিতেছিস বাবা। আসলে রেফারি কি মা সেটা জানতেন না। রেফারি আজাদ মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই মাঠে বাঁশি না বাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান নতুনদের সুযোগ দেবার জন্যই তিনি অবসর নিলেন। কোন খেলাটির কথা খুব মনে পড়ে? জিনেদিনি জিদান যেবার ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসে মোহামেডান আবাহনীর সঙ্গে যে ম্যাচের আয়োজন হয়েছিল সে ম্যাচটার কথা খুব মনে পড়ে। সেটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হলেও জিদানের জন্য সে ম্যাচে বাঁশি বাজানোর স্মৃতিটা তাকে আবেগে আপ্লুত করে তোলে। আজাদ রহমান ১৯৯৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মুচকি হাসি দিয়ে জানান বিয়ের মাত্র ২৩ ঘণ্টা পর বাস্কেট বল কোচেস এর ওপর ডিপ্লোমা করতে জার্মানি পাড়ি জমাতে হয়। স্ত্রী এবং দুই মেয়ে ফাইরুজ নাওয়া তরঙ্গ ও নুবাইদা আরস তটিনী কে নিয়ে সুখের সংসার। হ্যামিলনের বংশি বাদক নয়, নয় কোন অলস দুপুরে নদীর পাড়ে করুণ সুর তোলা কোন এক বাঁশিওয়ালা তিনি বাঁশি বাজিয়েছেন ফুটবল মাঠে। যেখান থেকে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা পাওয়া সত্যি খুব কষ্টের কিন্তু আজাদ রহমান সেই কঠিন কাজটি যেন খুব সহজেই পেয়েছেন। যা সম্ভব হয়েছে তার নিষ্ঠা আর সততার জন্য। আজাদ রহমান আর মাঠে বাঁশি বাজাবেন না, তবে গ্যালারিতে হাজারো মানুষের সঙ্গে অন্য কোন এক বাঁশিওয়ালার দেশের পক্ষে লম্বা বাঁশির আওয়াজ শুনতে চান বার বার।
×