ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ সোহেল রহমান

দেশী সফটওয়্যার

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

দেশী সফটওয়্যার

জাতি হিসেবে আমাদের বিদেশী পণ্য প্রীতি ঈর্ষণীয়। একটি কথা বর্তমানে খুবই প্রচলিত আমরা শুধু মুরগির ক্ষেত্রে দেশীটা খুঁজি আর সব ক্ষেত্রেই বিদেশী! আর দুঃখজনক হলেও আমাদের দেশের প্রায় সব সেক্টরেই এক অবস্থা। পরামর্শ দিয়ে শুরু করি। বিদেশী পরামর্শক আমাদের খুবই পছন্দ! তাদের মার্কিন ডলারে অতি উঁচু দরে বেতন দিতে আমাদের খারাপ লাগে না, কিন্তু দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে আমরা আস্থা পাই না। এমনকি সব চাইতে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে আমরা পুনঃ পুনঃ বিদেশী পরামর্শকদের ডেকে আনি, যা কিনা খাল কেটে কুমির আনার মতোই। এই কুমির শুধু যে আমাদের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো জেনে নেয়, তাই নয়, তা জানার জন্য বড় অঙ্কের পয়সাও পকেটে পুরে নেয়। বিষয়টি এমন যেন, আমাদের গোপন স্পর্শকাতর তথ্যগুলো তার মাথায় বা অন্য কোনখানে সংরক্ষণ করতে তার যে খরচ সেটাও তো উঠিয়ে নেয়া দরকার। তো পরামর্শ সেবার কথা থাক। এ লেখার মূল উদ্দেশ্য আসলে সফটওয়্যার শিল্প প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা। অনেকেই বার বার প্রশ্ন করেন, কেন আমরা ভারতের মতো বিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে তুলতে পারলাম না? এর একটা বড় কারণ বোধ করি বিদেশী পণ্যপ্রীতি এবং দেশী সফটওয়্যার প্রশ্নে আমাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং নীতিমালার ব্যাপারে সমন্বয়হীনতা। পৃষ্ঠপোষকতা বা ভাল নীতিমালা যে আমাদের একেবারেই নেই তা নয়। আমাদের দেশে অনেক সফটওয়্যার শিল্পবান্ধব নীতিমালা করা হয়েছে এবং হয়ত আরও হবে। আমাদের আইসিটি অধিদফতর এক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাও যেমনটি আশা, তেমনটি হচ্ছে না। যেমন মনে করুন, আইসিটি অধিদফতর সম্প্রতি একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে যেখানে তারা দেশীয় কোম্পানি দ্বারা একটি ইআরপি সফটওয়্যার তৈরি করবে। প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবেও রয়েছে দেশীয় পরামর্শক, যেমন, আমাদের সিএসই বিভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ প্রতিষ্ঠান। আমার কাছে এই প্রকল্পটিকে অসাধারণ মনে হয়েছে; কারণ এর মাধ্যমে আইসিটি অধিদফতর এবং এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছেন। এই চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সম্পূর্ণ দেশীয়ভাবে একটি আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার তৈরির চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে আমরা জয়ী হতে পারব বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর এজন্য সরকারসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে সাধুবাদ জানাই। পাঠক হয়ত ভাবছেন, পৃষ্ঠপোষকতা এবং নীতিমালার ব্যাপারে সমন্বয়হীনতার কথা তুলে আমি এই ইতিবাচক উদাহরণটি কেন টানলাম? আসুন তাহলে আবার আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। সম্প্রতি একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। সেটি হলো ইআরপি সফটওয়্যার সরবরাহ করার জন্য একটি ‘Request for Expression of Interest’। বিজ্ঞাপনটি পাওয়ার সেল নামক প্রতিষ্ঠানের, যা খোদ বাংলাদেশ সরকারেরই বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন। বিজ্ঞাপনটির শুরুতে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা রয়েছে। এমনকি ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ভিশন-২০২১ এর কথা সেখানে জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু যেখানে যোগ্যতার কথা এসেছে, সেখানে এসেই খেল খতম! বলা হয়েছে, যোগ্য হতে হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটিকে গত দশ বছরে গড়ে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার থাকতে হবে! সুতরাং একটি শর্ত দিয়েই দেশীয় সমস্ত সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো বাদ! যেখানে সরকারেরই একটি মন্ত্রণালয়/অধিদফতর অর্থাৎ আইসিটি অধিদফতর ইআরপি সফটওয়্যার তৈরির চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছে, সেখানে অপর একটি মন্ত্রণালয়, সে একই ধরনের সফটওয়্যার বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কেনার জন্য বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে! এই সমন্ব^য়হীনতার জন্যই বোধ করি আমরা আমাদের ভাল নীতিমালাগুলো কিংবা সরকারের অনেক পৃষ্ঠপোষকতার সুফল আসলে পাচ্ছি না। প্রায় একযুগ আগে আমাদের দেশে একটা বড় সম্ভাবনাকে আমরা গলা টিপে মেরে ফেলেছি বলে মনে হয়। এই ঘটনাটি ঘটেছে আমাদের ব্যাংকিং খাতে। একটা সময় আমাদের দেশীয় কয়েকটি কোম্পানি সাহস করে ব্যাংকিং সফটওয়্যার তৈরির কাজে হাত দিয়েছিল। আমরা সে সময় তাদেরকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারিনি। এখন আর দেশীয় ব্যাংকিং সফটওয়্যারগুলোর নামই শুনি না। প্রায় সব ব্যাংকই বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে এগুলো কেনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বার্ষিক মেইন্টেন্যান্স এবং ভার্সন পরিবর্তনের নামে কয়েক বছর পর পর বড় অঙ্কের টাকা এই বিদেশী সফটওয়্যার এর পিছনে চলে যায়। অথচ, বিষয়টা এ রকম নাও হতে পারত! সরকারের উচিত আইসিটি অধিদফতরের উপরে বর্ণিত প্রকল্পের মতো আরও প্রকল্প হাতে নেয়া যেখানে ইন্ডাস্ট্রি, একাডেমিয়া এবং সরকার একসঙ্গে কাজ করে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এতে সাময়িক ব্যর্থতা আসতে পারে- সেটা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি, একাডেমিয়া এবং সরকার এর মধ্যে এই যোগাযোগ যদি না থাকে আর যদি আমাদের নীতিমালাগুলো সমন্ব^য়হীনতার কারণে অকার্যকর অবস্থায়ই থেকে যায়, তবে আমরা আসলে যতখানি ডিজিটাল হবার স্বপ্ন দেখছি তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারব না। পরিশেষে, তাই বলি, আসুন আমরা দেশী মুরগির পাশাপাশি দেশী সফটওয়্যারের দিকেও মনোনিবেশ করি। লেখক : অধ্যাপক, বুয়েট [email protected]
×