ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এবার বিশ্ব স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশের শীতলপাটি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

এবার বিশ্ব স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশের শীতলপাটি

মোরসালিন মিজান ॥ এবার বিশ্বস্বীকৃতি লাভ করছে বাংলাদেশের শীতল পাটি। সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যগত পাটিকে ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ইউনেস্কো। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা আজ বুধবার সকালে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারে। এর আগে গত বছর এই স্বীকৃতি লাভ করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের অসংখ্য উপাদান। সংশ্লিষ্ট দেশের আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব উপাদান যাচাই-বাছাই ও সুনির্দিষ্ট করে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরার কাজ করে ইউনেস্কো। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির স্বীকৃতি লাভের মধ্য দিয়ে দেশ ওই উপাদানের আঁতুড়ঘর হিসেবে বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠি হয়, মর্যাদা লাভ করে। এ সংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষর করা সব দেশ প্রতি বছর নিজেদের যে কোন একটি উপাদানের স্বীকৃতি চেয়ে ইউনেস্কোতে আবেদন করতে পারে। এ বছর ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ। স্বীকৃতিদানের মূল কাজটি করে ইন্টারগবর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ। কমিটির দ্বাদশ সম্মেলন এখন চলছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। ১২ সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছে ৮ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল। জাতীয় জাদুঘরের সচিব শওকত নবীর নেতৃত্বে দলে আরও আছেন জাদুঘরের কীপার ড. শিখা নূর মুন্সী, ডেপুটি কীপার আসমা ফেরদৌসী। প্র্যাকটিশনার হিসেবে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন সিলেটের দুজন প্রসিদ্ধ পাটি শিল্পী শ্রী গীতেশ চন্দ্র দাশ ও শ্রী হরেন্দ্র কুমার দাশ। তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর। তিনি জানান, বুধবার আলোচনার টেবিলে ওঠে শীতল পাটি। স্বীকৃতিদানের পক্ষে যুক্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু ওই দিনের অধিবেশনের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত ঘোষণাটি আসেনি। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে আনন্দের খবরটি পাওয়া যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। একই দিন ইমেইলে জনকণ্ঠকে জাদুঘরের কীপার ড. শিখা নূর মুন্সী জানান, নমিনেশন ফাইলে করা প্রাথমিক আবেদনের যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞ কমিটি। ছয় দেশের ছয়জন প্রখ্যাত আইসিএইচ বিশেষজ্ঞ দ্বারা গঠিত হয় সাবসিডিয়ারি বডি। বডি এক বছর ধরে বিভিন্ন দেশের মনোনয়ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের অভিমত জানায়। ২৪ সদস্যবিশিষ্ট মূল কমিটির বিবেচনার জন্য প্রেরণ করে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ক্যাটাগরির সবকটিতেই শতভাগ নম্বর পেয়েছে শীতলপাটি। এর পর থেকে এটি প্রাথমিক তালিকায় ছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও বিষয়টি সবসময় তদারকি করেন। শীতল পাটির বিশ্ব স্বীকৃতি প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ। গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে আমাদের। বিশ্বদরবারে সেগুলোর কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে শীতল পাটির স্বীকৃতি চাওয়া হয়। উপাদানটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। তবে ইউনেস্কোর নিয়ম ও শর্তগুলো বুঝে, যথাযথভাবে অনুসরণ করে ফাইল তৈরি করতে হয়। আমরা সেসব বিষয়ে সজাগ ছিলাম। সিরিয়াসলি কাজ করেছি। ফলে আমাদের বক্তব্য ইউনেস্কোর কাছে বোধগম্য হবে বলেই আশা। তিনি বলেন, দেশ অর্থনৈতিকভাবে যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি এগিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিকভাবে। আরও অনেক অর্জনের জন্য সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি। প্রসঙ্গত, মানবজাতির উল্লেখযোগ্য মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে ২০০৩ সালে ইউনেস্কো একটি সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন করে। এই সমঝোতা চুক্তির অধীনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৭১টি রাষ্ট্র এই সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০০৯ সালের ১১ জুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ২০১২ সাল থেকে সরকারের পক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মানবজাতির মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য উপাদান পাঠানো শুরু করে। ইউনেস্কোর প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীত। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুননশিল্প লাভ করে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। গত বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা একই স্বীকৃতি লাভ করে। জানা যায়, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের জন্য উপাদানের পক্ষে নির্ভুল নমিনেশন ফাইল প্রস্তুত করা খুব জরুরি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতীয় জাদুঘরকে ফাইলটি তৈরির দায়িত্ব দেয়। এর জন্য প্রায় এক বছর গবেষণা, আলোকাচিত্র ও ভিডিও চিত্র নির্মাণসহ বেশকিছু কাজ করে জাদুঘর। আনন্দের খবরটি সামনে রেখে তাই জাতীয় জাদুঘর আয়োজন করেছে শীতল পাটি প্রদর্শনীর। নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে সন্ধ্যায় বিশেষ এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পী চন্দ্রশেখর সাহা। জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। প্রায় ৭০টির মতো শীতল পাটি নিয়ে সাজানো হয়েছে গ্যালারি। যে গাছ থেকে সিলেটের শীতলপাটি তৈরি হয় সেই মুর্তা গাছ এবং পাটি তৈরির নানা উপকরণ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সিলেট থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে প্রকৃত শিল্পীদের। তারা চোখের সামনেই পাটি বুনার কাজ করছেন। মৌলভী বাজারের রাজনগরের শিল্পী আরতি রানী ইউনেস্কো বুঝেন না। বুঝেন ‘বিদেশ।’ সেই বিদেশ থেকে তাদের কাজের প্রশংসা করা হচ্ছে জেনে খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, বালা খবর ফাইয়ার। নায়নি? অবশ্য পরক্ষণেই তিনি জানান, একসময় তার গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে শীতলপাটি বুনার কাজ হতো। এখন ১২০টি ঘরে অল্পস্বল্প চালু আছে। দুঃখ করে তিনি বলেন, ‘খাম খরি। ফয়সা আয় না। বুজছইননি? কিলা বাঁচতায় তে?’
×