ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারে মুখর নগরী, উল্লসিত কর্মী-সমর্থক

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারে মুখর নগরী, উল্লসিত কর্মী-সমর্থক

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ৫ ডিসেম্বর ॥ সোমবার বেলা ২টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী প্রচার। প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই নিজ নিজ এলাকায় প্রচারে নেমেছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে নগরী। প্রচার মাইকের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে নগরীর চারদিক। আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামার সুযোগ পেয়ে নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছেন উল্লসিত কর্মী-সমর্থকরা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দেখা গেছে সাজসাজ রব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীরা সভা-সমাবেশের পাশাপাশি সরাসরি ভোটারদের সঙ্গে দেখা করে ভোট চাচ্ছেন এবং সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছেন। মঙ্গলবার সকালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু প্রচারে নামেন নগরীর কুকরুল এলাকায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি সেখানে নির্বাচনী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘পাঁচ বছর মেয়র পদে থাকাকালীন এমন কোন অন্যায় করিনি, যার কারণে জনগণ আমাকে ভোট দেবে না। আমি সিটি কর্পোরেশনের অনেক উন্নয়ন করেছি। সেই উন্নয়নের ধারাকে ধরে রাখতে এবারও জনগণ আমাকে বিপুল ভোটে জয়ী করবে বলে আমি আশাবাদী।’ জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা নগরীর গ্র্যান্ড হোটেল মোড় এলাকা থেকে জনসংযোগ শুরু করেন। এরপর তিনি প্রেসক্লাব চত্বর, সেন্ট্রাল রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের দুপাশের দোকানদার, ব্যবসায়ী ও পথচারীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তিনি প্রত্যেকের হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিয়ে লাঙল মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। এ সময় জাতীয় পার্টির মহানগর সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আহাম্মেদসহ দলের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে ছিলেন। জনসংযোগকালে মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ ও আমাকে নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা বলছেন। এর মাধ্যমে তিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। কারণ কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। এছাড়া তিনি একটি লিফলেট ছাপিয়েছেন, যার মাধ্যমে আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিফলেট পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আশা করি, তিনি ব্যবস্থা নেবেন।’ নির্বাচনে তিনি ভোটারদের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাচ্ছেন দাবি করে বলেন, ‘যেহেতু রংপুর এরশাদের দুর্গ সে কারণে আমি বিপুল ভোটে জয়ী হবো।’ এবং বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা সাতমাথা এলাকায় প্রচারে নামেন। বিএনপি প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা নগরীর মাহিগঞ্জ, সাতমাথাসহ আশপাশের এলাকায় জনসংযোগ করেছেন। তিনি ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন এবং দোয়া চেয়েছেন। ধানের শীষে ভোট দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। কাওসার জামান এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ায় বিষয়ে এখনও আমার মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ৫ জানুয়ারি বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসার পর কোন নির্বাচনই অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। এখনও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করেনি নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউন করছেন, এ কারণে বিএনপিকে কোন সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।’ সব দলকে সমান সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। প্রথম দিনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর বিরুদ্ধে আচরণ বিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। বিষয়টি কমিশনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। মোস্তফার অভিযোগ, ‘ঝন্টু তার প্রচারপত্রে জাতীয় পার্টিকে ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যা স্পষ্টভাবেই নির্বাচনের আচরণ বিধি ভঙ্গ।’ এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বলেন, সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু কিছু লিফলেট বিতরণ করেছেন। সেই লিফলেটে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীকে ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘জাতীয় পার্টিও প্রার্থীকে ভোট দিবেন না, মফিজ হবেন না’। এ বিষয়ে রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, এখনও আমি কোন অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ১১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ১১টি ভিজিলেন্স টিম মাঠে কাজ করছে। ১৯৩টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে যে ১২৮টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনকে ঘিরে বিশিষ্ট জনদের ভাবনা রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। আগামী ২১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে এরই মধ্যে মানুষের মাঝে উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কে হচ্ছেন আগামী পাঁচ বছরের জন্য রসিক মেয়র এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানান ধরনের জল্পনা-কল্পনা। নাগরিক আলোচনায় স্থান পেয়েছে, ‘কেমন মেয়র চাই’। এ বিষয়ে রংপুরের বিশিষ্ট লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, সহকারী অধ্যাপক ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য বলেছেন, গত নির্বাচনের পর মানুষের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মাঝে বিস্তর ফারাক প্রত্যক্ষ করেছে নগরবাসী। যে পরিমাণে উন্নয়নের প্রত্যাশা ছিল সে পরিমাণ উন্নয়ন হয়নি। বিশেষ করে একটি সিটি কর্পোরেশনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, যানবাহনের চলাচলের পরিকল্পনা, সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নগরবাসী ভোগ করতে পারেনি। তাই এবার মেয়র নির্বচনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ অনেকটাই বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেছেন, রংপুরের মানুষ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশী। তাদের প্রত্যাশা একটি পরিকল্পিত নগর যা হবে আবর্জনা মুক্ত, যানজট মুক্ত এবং মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত। যানজট এই নগরের একটি বড় সমস্যা। একটি মাত্র প্রধান রাস্তা মডার্ন মোড় থেকে রংপুর মহানগরের বুক চিড়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত চলে গেছে। তার দু’পাশে অর্ধেক রাস্তা দখল করেছে অবৈধ দোকানদার, ব্যবসায়ীরা। রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। নগরের মাঝ দিয়ে আরও ক’টি প্রশস্ত সড়ক বানাতে হবে। তার প্রত্যাশা সাইকেল আরোহীদের চলাচলের জন্য একটি বাইলেন থাকবে। আরেকটি বড় প্রত্যাশা এই শহরের ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খালকে পরিকল্পিতভাবে পুনঃখনন করে এর জীবন দান করা। কারণ এই শ্যামাসুন্দরী খাল রংপুরের যেমন ঐতিহ্য, তেমনি রংপুর শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমের একটি প্রধান নিয়ামক। ড. শাশ্বত বলেন, আগামী মেয়রের কাছে নগরবাসী আশা করে একটি পরিকল্পিত সুন্দর নগর; যেখানে সকল নাগরিক সুবিধা থাকবে। এই সিটি কর্মোরেশনের আওতায় অসংখ্য সরকারী-বেসরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিএড কলেজ, ল’ কলেজ রয়েছে। সুতরাং রংপুরকে অবশ্যই একটি শিক্ষানগরী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ কারণেই শিক্ষা বিষয়ক সকল সম্ভাবনার দ্বার যাতে উন্মোচিত হয় সে বিষয়ে মেয়রকে নজর রাখতে হবে। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং লেখক হিসেবে এ প্রত্যাশা নিশ্চয় অযৌক্তিক হবে না যে রংপুর শহরের সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রটি যাতে সংস্কৃতিকর্মী বান্ধব হয় সেটির প্রতি নজর রাখবেন আগামীর নগরপিতা। পাশাপাশি নগরপিতা যেন জনবান্ধব, সদাহাস্যোজ্জ্বল হন এবং তার দারজা যাতে প্রতিটি মানুষের জন্য সদা উন্মুক্ত থাকে এমনটাই কাম্য। ‘কেমন মেয়র চাই’- এ প্রশ্নের জবাবে মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সদরুল আলম দুলু বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সমৃদ্ধ নগরী তৈরি করা মেয়রের প্রধান দায়িত্ব। তিনি বলেন, রংপুর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শ্যামাসুন্দরী খাল এখন মশা প্রজননের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অথচ ব্রিটিশ আমলে পীড়ার আকড় ভূমিতে যখন পরিণত হয়েছিল রংপুর, তখন রাজা জানকি বল্ভ সেন এই শহরের বুকচিড়ে খাল খনন করে রোগ-ব্যাধি দূর করেছিলেন। তিনি তার মায়ের নামানুসারে এর নাম দিয়েছিলেন শ্যামাসুন্দরী খাল। তখন পানির প্রবাহ ছিল। শহরের সব পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে যেত এই খালে। অথচ এই খাল এখন মৃতপ্রায়। নেই পানির প্রবাহ। ময়লা ফেলতে ফেলতে তা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এটিকে রক্ষা করতে হবে। খালটি পরিষ্কার করে এতে পানি প্রবাহের সুযোগ করে দিতে পারলে কমে আসবে মশার উপদ্রব। নগরবাসীর কল্যাণে উন্নয়নমূলক কর্মকা- করতে হবে। আমরা এমন দক্ষ মেয়রই চাই যিনি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে ফান্ড নিয়ে আসতে পারবেন এবং সততার সঙ্গে এলাকার উন্নয়ন করে যাবেন। সম্প্রসারিত এলাকার উন্নয়নকেও মেয়রের মাথায় রাখতে হবে। সম্প্রসারিত এলাকাগুলো থেকে আয় না হলেও উন্নয়ন করতে হবে সমভাবে। বিভাগীয় শহর হিসেবে রংপুরে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম জরুরী। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সদরুল আলম দুলু বলেন, আমরা জানি সিটি কর্পোরেশন থেকে এমনিতেই দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়া হয়। এই সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এসব বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সততার সঙ্গে যিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেনÑ সে রকম একজনকেই এবার মেয়র নির্বাচিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা চাই রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকা হবে মানুষের সুন্দরভাবে-সুষ্ঠুভাবে বসবাসের উপযোগী একটি শহর। এই শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশ আমরা কখনোই আশা করি না। সে প্রচেষ্টা চালাতে হবে আগামীর মেয়রকে। নগরীর প্রধান সড়কসহ পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোও প্রশস্ত করতে হবে। যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে যানবহনসহ মানুষজন সহজে চলাচল করতে পারে। রাতের বেলায় প্রতিটি সড়কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধান সড়ককেও যানজট মুক্ত রাখতে হবে। ফুটপাত উন্মুক্ত রাখতে হবে পথচারীদের জন্য। যদিও সেটা ট্রাফিক পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। তবে এক্ষেত্রে মেয়রকে তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে সিটি পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচন অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয় না। এ ক্ষেত্রে দলের চেয়ে ব্যক্তি বিবেচনায় ভোট দেয়া উচিত। এমন একজন ব্যক্তিকে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করা দরকার যিনি এই নগরের মানুষের চাহিদা বুঝবেন। সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকবেন। নগরের উন্নয়নে কাজ করবেন। সুখে-দুঃখে নগরবাসীর পাশে দাঁড়াবেন।
×