ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ হানাদার মুক্তদিবস যেখানে-

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

আজ হানাদার মুক্তদিবস যেখানে-

যশোর স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ আজ ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক যশোর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনেই যশোর জেলা পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। এদিন বিকেলে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। যশোরেই প্রথম উঠেছিল বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সূর্য খচিত গাঢ় সবুজ পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ- যুদ্ধ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীও সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা ও গোলা নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পর্যদস্তু পাক বাহিনী ৫ ডিসেম্বর থেকে পলায়ন শুরু করে। যশোর সেনানিবাস ছেড়ে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পলায়নকালে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর শহরতলীর রাজারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচ- লড়াই হয়। ৬ ডিসেম্বর বিকেলের আগে যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় পাক হানাদাররা। বিকেলে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তি বাহিনী সেনানিবাসে প্রবেশ করে দখল নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে শহরে। শ্রীবরদী নিজেস্ব সংবাদদাতা শেরপুুর থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর শ্রীবরদী মুক্ত দিবস। একাত্তরের এদিনে পরাজিত হয় পাক হানাদার বাহিনী। এ যুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হন শ্রীবরদী অঞ্চলের ৩১ মুক্তিযোদ্ধা। নির্বিচারে হত্যার শিকার হয় অনেক গ্রামবাসী। কিন্তু বিজয়ের ৪৬ বছর পরও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি উপজেলার বিভিন্ন বধ্যভূমি। জানা যায়, ৫ ডিসেম্বর রাতে কামালপুর থেকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বকশীগঞ্জ হয়ে পাকিস্তানি মেজর আইয়ুব জামালপুরে যাবেÑ এ খবর ছড়িয়ে পড়ে শ্রীবরদীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। এজন্য তারা স্থানীয় টিকরকান্দি এলাকায় সম্মুুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। মেজর আইয়ুব সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে সেই রাস্তায় যাওয়ার পথে শুরু হয় যুদ্ধ। স্থলমাইন বিস্ফোরণ আর গুলির বিনিময়ের মধ্যে পরাজিত হয় মেজর আইয়ুবসহ পাক সেনারা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ভোরে শতশত লোক বকশীগঞ্জ সড়কে গিয়ে জড়ো হয়। সবার কণ্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। সেখান থেকে দলে দলে উচ্ছ্বসিত মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধারা যায় শ্রীবরদী বাজারের পুরাতন হাসপাতাল মাঠে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ওইসব মুক্তিকামী মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধারা। সেই পাক হানাদার বাহিনীর পরাজিত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সী (বীরপ্রতীক ‘বার’) বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে এদিন ছিল শ্রীবরদীর জন্যে বিজয়ের দিন। কলাপাড়া নিজস্ব সংবাদদাতা কলাপাড়া থেকে জানান, কলাপাড়া মুক্ত দিবস আজ, ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সাগরপারের কলাপাড়াকে শত্রুমুক্ত করেন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানী শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত করতে সেদিন ৬ ঘণ্টা যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কলাপাড়া থানা দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দেন স্বাধীন বাংলার আকাশে লাল-সবুজের পতাকা। এই দিনটি কলাপাড়াবাসীর কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। সেদিন যুদ্ধ পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব পালন করেন ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেয়া অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ রানা। তিনি জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ ডিসেম্বর রাত আটটায় মুক্তিযোদ্ধারা কলাপাড়া থানা আক্রমণ করে। কমান্ডার রেজাউল করিম বিশ্বাস, ডেপুটি কমান্ডার হাবিবুল্লাহ রানা, এসএম নাজমুল হুদা সালেক, শাহ আলম তালুকদার, সাজ্জাদুল ইসলাম বিশ্বাস, আরিফুর রহমান মুকুল খান, সেনাবাহিনীর নায়েক আহম্মেদ আলী, নায়েক আশরাফ আলী, আবু তালেবসহ ৯ জন বিএলএফ যোদ্ধা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কলাপাড়া থানা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার হাবিবুল্লাহ রানা জানান, কলাপাড়া থানায় পাকিস্তানী শত্রু অবস্থান করছিল। কুড়িগ্রাম স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১’র এই দিনে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের হটিয়ে কুড়িগ্রামকে মুক্ত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হলেও এ অঞ্চলে সেদিন উদিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে সেই বিজয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন সেদিনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৬ ও ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল গোটা কুড়িগ্রাম অঞ্চল। শুধু ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারী ছিল মুক্তাঞ্চল। এখানেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ৬ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে একে একে পতন হতে থাকে পাক সেনাদের শক্ত ঘাঁটিগুলো। মুক্ত হয় ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, চিলমারী, উলিপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। এরপর পাক সেনারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে কুড়িগ্রাম শহরে। হাই বাহিনী কুড়িগ্রাম শহরকে মুক্ত করতে ৫ ডিসেম্বর পাক সেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের পাশাপাশি মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় বেসামাল হয়ে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে হাজারও মুক্তিকামী মানুষ সেদিন মিলিত হয় বিজয় মিছিলে। মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকারের বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতায় তার নেতৃত্বে গঠিত হয় হাই বাহিনী। রণাঙ্গনে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে একে একে দখল করে নেয় পাক সেনার শক্ত ঘাঁটিগুলো। আব্দুল হাই বীর প্রতীক জানান, ৫ ডিসেম্বর থেকে কুড়িগ্রাম মুক্ত করতে পাক হানাদার বাহিনীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রথমে শহরের ওভারহেট পানির ট্যাঙ্কে প্রথম পতাকা উত্তোলন করি। ঝিনাইদহ নিজস্ব সংবাদদাতা ঝিনাইদহ থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর, ঝিনাইদহ হানাদার মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার ও এদেশে তাদের দোসরদের হটিয়ে ঝিনাইদহকে শত্রুমুক্ত করে। মুক্তির আনন্দে সেদিন রাস্তায় নেমে আসে নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষ। সেদিন উল্লাসে আর আনন্দে তারা ফেটে পড়ে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দেশে প্রথম যে সম্মুখ সমর হয় তা সংঘটিত হয়েছিল ঝিনাইদহের বিষয়খালীতে। ১ এপ্রিল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক বাহিনী ঝিনাইদহ দখলের জন্য এগিয়ে আসে। সেদিন বিষয়খালীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা বেগবতি নদীর ধারে তাদেরকে প্রবল বাধা দেয়। প্রায় ৩ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৬ এপ্রিল তারা আরও অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আবারও বেগবতি নদীর তীরে বাধার সম্মুখীন হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ওই রাতেই ঝিনাইদহ শহরের পতন হয়। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর থেকে দলে দলে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উল্লাস করতে থাকে। ফুল দিয়ে তারা মুক্তিসেনাদের বরণ করে নেয়। ৬ ডিসেম্বরের এ দিনটি ঝিনাইদহবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দুর্গাপুর নিজস্ব সংবাদদাতা দুর্গাপুর থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর দুর্গাপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুরকে মুক্ত করে। পাকহানাদার বাহিনীর মেজর সুলতানের নেতৃত্বে দুর্গাপুরের মিশনারিজ এলাকা বিরিশিরিতে একটি শক্তিশালী পাকসেনা ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল, আর এখানে বসেই পাকসেনারা বাংলার কুখ্যাত দালাল, আলবদর, রাজাকারদের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণ করত দুর্গাপুর সদরসহ কলমাকান্দার সীমান্ত এলাকা লেংগুড়া, নাজিরপুর এবং দুর্গাপুরের বিজয়পুর। সেইসঙ্গে রাতের আঁধারে বিরিশিরির বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো মুক্তিকামী মানুষদের। যাদের সর্বপ্রথম হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছে দুর্গাপুর কৃষাণ কলেজের অধ্যক্ষ আরজ আলী, সাবেক প্রধান শিক্ষক আশুতোষ সান্যাল, এমকেসিএম পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আওয়াল, দুর্গাপুরের তদানিন্তন এমএনএ পুরাকান্দুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা, কুল্লাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আলী হোসেন ও আশুতোষ সান্যাল উল্লেখযোগ্য। দুর্গাপুর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলহাজ রুহুল আমীন চুন্নু জানান, ১৯৭১ সালের ৪ মে ২ পা সেনা গাঁওকান্দিয়া গ্রামে গিয়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে নারী ধর্ষণের চেষ্টা চালালে ছোট্টুনীর নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা তাদের ধরে কুপিয়ে হত্যা করে। এরই জের ধরে ৫ মে বিরিশিরি ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক ঝাঁক পাকসেনা গাঁওকান্দিয়া গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষসহ ১৯ গ্রামবাসীকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে গুলি করে ও পুড়িয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া সুসং ডিগ্রী কলেজের ছাত্র দিলদার হোসেন, কৃষক ইমাম হোসেন, বিল্লাল হোসেনসহ নাম না জানা অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল।
×