ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

ঢাকা মাতিয়ে গেলেন এশিয়ার সেরা তীরন্দাজরা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

ঢাকা মাতিয়ে গেলেন এশিয়ার সেরা তীরন্দাজরা

টার্গেটে আন্দাজ করে তীর ছোড়েন তীরন্দাজ। এটাই তার একমাত্র কাজ। ছন্দে ছন্দে যে খেলাটি সম্পর্কে তিনটি বাক্য বলা হলো, তা হচ্ছে তীর-ধনুকের খেলা আরচারি। তীর-ধনুকের খেলা আরচারি। ইংরেজী ‘আরচরি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ধনুর্বিদ্যা বা তীরন্দাজের সৈন্যদল। আদিম যুগের মানুষেরা মাংসাশি প্রাণী শিকার করে ক্ষুধা নিবারণ ও হিংস প্রাণীর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য উদ্ভাবন করেছিল তীর-ধনুকের মতো অস্ত্রের। পরবর্তীতে অবশ্য এ অস্ত্রটি শিকার ও নিজেকে বাঁচানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরিণত হয় মানুষ হত্যার প্রধান হাতিয়ারে! আধুনিক যুগে গুলি, বন্দুক, বোমা আবিষ্কার হওয়াতে তীর-ধনুকের গুরুত্ব আর নেই। না, আছে। সেটা খেলাধুলাতে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে আরচারি হচ্ছে অন্যতম। ভুটানে তো এটি জাতীয় খেলা হিসেবেই স্বীকৃত! বিশ্ব আরচারি এশিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত হয় এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ। ১৯৮০ সালে টুর্নামেন্টের যাত্রা শুরু। এবারের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। গত ২৫-৩০ নবেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতার ২০তম আসর। এশিয়ান আরচারির সবচেয়ে বড় এই প্রতিযোগিতা তীরন্দাজদের পদচারণায় মুখরিত ছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ১০ ইভেন্টে ৩০টি পদকের জন্য ২৮৬ আরচার লড়েন। এই আসরে গত আসরের মতো এই আসরেও শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখে দক্ষিণ কোরিয়া। টুর্নামেন্টের মোট ৩০ পদকের প্রায় অর্ধেক এবং মোট স্বর্ণের প্রায় সবগুলোই জিতে নেয় তারা। তাদের প্রাপ্তি ৮ স্বর্ণ, ৪ রৌপ্য এবং ২ তা¤্রপদক। গতবারের মতো এবারও রানার্সআপ হয় ভারত (২-৩-১)। তৃতীয় হয় জাপান (২টি রৌপ্যপদক)। এবারের আসরে মোট ৩২ দেশ অংশ নেয়। তাতে মাত্র ১০ দেশই পদক জেতে। এর মধ্যে কোরিয়া আর ভারত ছাড়া আর কোন দেশ স্বর্ণপদক করায়ত্ত করতে পারেনি। এছাড়া বাংলাদেশসহ বাকি ২৩টি দেশই কোন পদক জিততে পারেনি। পদক না জিতলেও দারুণ পারফর্মেন্স করেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। দলগত র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ১০-এ থাকার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের। আর রিকার্ভের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেই যথেষ্ট। সেই প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলার ধনুর্বিদরা। এই আসরে যে কোন ইভেন্টের সেমিফাইনালে ওঠাই হচ্ছে স্বাগতিক বাংলাদেশের আরচারির ইতিহাসে সেরা সাফল্য। কিন্তু মেয়েদের কম্পাউন্ড দলগত ইভেন্টে ভারতের কাছে হেরে শেষ চারেই থমকে যেতে হয় সুস্মিতাদের। ফাইনালে উঠতে না পেরে স্বর্ণ ও রৌপ্য জেতার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেলেও সুযোগ ছিল তা¤্রপদক জেতার। কিন্তু সেই লড়াইয়ে ইরানের কাছে হার মানতে হয়। মনোসংযোগের অভাব এবং আবহাওয়ার কারণে প্রত্যাশিত ফল পায়নি বাংলাদেশÑ খেলা শেষে এমন কথাই জানান বাংলাদেশের তীরন্দাজরা। পুরুষ বিভাগের কম্পাউন্ড নিয়ে বাংলাদেশের কোন প্রত্যাশাই ছিল না। অথচ সেখানে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত উঠে চমক দেখান আবুল কাশেম মামুন। কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি হেরে যান ভারতের অভিষেক ভার্মার কাছে, ১৪৮-১৮১ পয়েন্টে। পুরুষদের রিকার্ভ বিভাগে বাংলাদেশের আশার প্রতীক ধরা হয়েছিল যাকে, সেই রোমান সানা চতুর্থ রাউন্ডে চাইনিজ তাইপের লি ইয়ান ইউর কাছে হেরে বিদায় নেন। যার আছে দারুণ তিনটি রেকর্ডÑ আন্তর্জাতিক আরচারিতে বাংলাদেশী আরচার হিসেবে এককে সবচেয়ে বেশি (৪টি) স্বর্ণপদক অর্জন, প্রথম ও একমাত্র আরচার হিসেবে টানা তিন বছর জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বণপদর্ক অর্জন, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১৪) এককে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন (৩৩৫, আগের রেকর্ডÑ ২০১০ আসরে ইমদাদুল হক মিলনের ৩৩৩ পয়েন্ট)। এবার আসা যাক আয়োজন নিয়ে। একেবারেই অনাড়ম্বর আয়োজনে শুরু হয় এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ। উদ্বোধনী পর্বে জাঁকজমকের বালাই ছিল না। একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে সমাপনীতেও। এত বড় আয়োজন, অথচ বিস্ময়করভাবে আয়োজকদের উদাসীনতা ছিল দৃষ্টিকটু। বিভিন্ন দেশ থেকে আরচাররা এই আসরে খেলতে এসেছে। অথচ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল শিথিল, ঢিলেঢালা! ভেন্যু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যে কেউই প্রবেশ করতে পেরেছেন বিনা বাধায়। গত মাসের ২৬ তারিখে এই আসরের লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে আনা হয়েছিল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেলকে। অথচ আসরের উদ্বোধন করতে ওই পর্যায়ের কাউকেই হাজির করতে পারেনি আরচারি ফেডারেশন! শেষে বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজাকে দিয়েই উদ্বোধন করানো হয়। প্রথম দিনে আরচারদের অনুশীলন শেষে পল্টনে অবস্থিত শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানেও বহিরাগতদের ঢুকতে বাধা দেয়া হয়নি। এছাড়া রাস্তায় তীব্র যানজটের কারণে আরচারদের আসা-যাওয়ায় পোহাতে হয় নানা বিড়ম্বনা। অথচ এতকিছুর পরও আরচারি ফেডারেশন দাবি করে আসরটি তারা নাকি সফলভাবেই সম্বপন্ন করেছেন! ছয় দিনব্যাপী এই প্রতিযোগিতা কভার করতে গিয়ে বাংলাদেশসহ অনেক আরচারের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়েছে। হয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যেমন শোনা যাক ইরানিয়ান আরচার দম্পতি মজিদ ঘেইদি-পাভিসা বারাচির গল্প। পাঁচ বছর ধরে চেনাশোনা। কিন্তু একবারও মুখ ফুটে বলতে পারেননি সাহসের অভাবে। একদিন সাহস সঞ্চয় করে হাঁটু গেড়ে বলেই ফেললেন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি!’ মজিদ ভেবেছিলেন তার চেয়ে দুই বছরের বড় পাভিসা হয়ত প্রত্যাখ্যান করবেন তাকে। কিন্তু না, পাভিসা তাকে চমকে দিলেন এই বলে, ‘এই কথাটি শোনার জন্যই এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম, এত দেরি করলে কেন?’ এরপর মাসখানেক পরেই শুভ পরিণয়। তার দু’মাস পরেই এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে এই দম্পতি চলে এলেন ঢাকায়। ফিলিপিনো তীরন্দাজ আমায়া কোজুয়াঙ্গকোর রান্না করায় পারদর্শীতার গল্পটাও বেশ মজার। ৩২ বছর বয়সী সুদর্শনা ও এই দীর্ঘাঙ্গী আরচার খেলার সুবাদে এ পর্যন্ত ২০টির মতো দেশে সফর করেছেন। বাংলাদেশ আপাতত তার সর্বশেষ দেশ। যে দেশেই যান, সে দেশের খাবার আস্বাদন করেন, সেটার রেসিপি লিখে নেন এবং দেশে ফিরে তা রান্না করে সবাইকে ভুরিভোজন করাতে ভালবাসেন। এই প্রতিবেদকেও তিনি তার দেশে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসার নিমন্ত্রণ জানান! তাজিককন্যা মেহরনা আভাজোভা। বয়স মাত্র ১৬। এই আসরের সর্বকনিষ্ঠা আরচার। মাতৃভাষা রুশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজী এবং জার্মান ভাষাতেও কথা বলতে পারঙ্গম। তার প্রথম ও বর্তমান কোচ ফিরুজা যুবাদোভাভা। তিনিও ঢাকায় আসেন মেহরনার সঙ্গে। উল্লেখ্য, ফিরুজাও একজন আরচার। তিনিও খেলেন এই আসরে। তাঁর বয়স ৫০, যা এই আসরে সবচেয়ে বেশি বয়সী আরচারের রেকর্ড। মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ মেহরনার আদর্শ আরচার হচ্ছেন কিছু রুশ আরচার, যাদের একজনের নামও অনেক চেষ্টা করে বলতে পারেননি তিনি! রাদিয়া আক্তার শাপলা। বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিশীল-মেধাবী জাতীয় তীরন্দাজ। মেয়েদের রিকার্ভ এককে বাই পেয়ে শেষ ২৪-এ ওঠেন শাপলা। কিন্তু এ পর্বে তিনি ৬-২ সেটে হারে চীনের লিভিনার কাছে। এখানেই শেষ নয়। দিনের শেষভাগেও আরেকটি ব্যর্থতার সঙ্গী হন তিনি। রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈতে চাইনিজ তাইপের কাছে হেরে যান তিনি। শাপলার সঙ্গী ছিলেন রোমান সানা। রোমান ভাল পারফর্মেন্স করলেও শাপলার পারফর্মেন্স প্রত্যাশিত হয়নি। একটা পর্যায়ে বাংলাদেশ দল ভাল অবস্থানে থেকেও অনাকাক্সিক্ষতভাবে হেরে যায়। খেলা শেষে রোমানকে মাঠে দেখা গেলেও শাপলাকে দেখা যায়নি। প্রায় বিশ মিনিট ধরে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যাওয়া! কেউ বললো, শাপলা হোটেলে ফিরে গেছেন। কারোর ভাষ্যÑ তিনি খুব আপসেট, মন খারাপ, তাই নিজেকে সামলাতে তাই চলে গেছেন। এমন সময়ই হঠাৎ আবার মাঠে দেখা গেল শাপলাকে, ব্যাগ গোছাচ্ছেন। জিগ্যেস করলাম, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? স্মিত হেসে জানালেন ওয়াশরুমে।’ দক্ষিণ কোরিয়ান আরচার কি বো বে। দারুণ সুন্দরী। গত ২০১২ ও ২০১৬ অলিম্পিকে স্বর্ণপদকধারী। অথচ প্রত্যাশার চাপে এবার মাত্র ১টি স্বর্ণ জেতেন, তাও দলগত। ভারতীয় আরচার দীপিকা কুমারীর কথা না বললেই নয়। অটোরিক্সা চালক বাবা এবং নার্সের মেয়ে তিনি। ছোটবেলায় পাথরের টুকরো দিয়ে আম পাড়তেন। এই লক্ষ্যভেদ করার দক্ষতাই তাকে পরবর্তীতে তীরন্দাজ হিসেবে গড়ে তোলে। তবে দীপিকার তীরন্দাজ হওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তার মা-বাবাকে। কেননা আরচারির সরঞ্জামের অনেক দাম। এগুলো কিনতে হিমশিম খেতে হতো মাহাতো দম্পতিকে। ঘরে তৈরি বাঁশের তীর-ধনুক দিয়ে আরচারি অনুশীলন করতে হয়েছে দিপীকাকে!
×