ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সেদিনের সেই ৭ মার্চ শক্তি ও সাহসের উৎস

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

সেদিনের সেই ৭ মার্চ শক্তি ও সাহসের উৎস

ইউনেস্কো সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে তাদের ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্ব দরবারে বাঙালীর অর্জন তেমন নয়, এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটির স্বীকৃতিতে কতিপয় স্বার্থান্ধ রাজনীতিক এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অংশ ছাড়া সকলেই কম বেশি-খুশি হয়েছে। কম-বেশি বলছি এই কারণে যে, একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ৪৭ বছর লাগল বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে খুঁজে বের করতে! এই ভাষণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালীরা মৃত্যুভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষে ৯৩ হাজারের বিশাল শত্রু সৈন্য দলকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে মাত্র নয় মাসে মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর অন্যান্য জাতির জীবনে ৭ মার্চ সাধারণ একটি দিন হিসেবে গৃহীত হলেও বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলীন (যা কখনোই সম্ভব নয়) না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকলের কাছে এই তারিখটি তার নিজস্ব আবেদন নিয়েই অনাগত ভবিষ্যতে আসবে এবং স্মরণ করিয়ে দেবে সেদিনের বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ, উত্তাল ঢাকা ও রমনা রেসকোর্স, সেই বজ্রকণ্ঠ- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব... এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’। ক্যালেন্ডারের পিঠে চেপে হাজির হয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চ। বাঙালীরা এবার নিজেরাই হবে নিজেদের রাজা। হাজার বছরের তাদের এই স্বপ্ন, এই আকাক্সক্ষা। কিন্তু ১ তারিখ দুপুরে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ করেই স্থগিতের ঘোষণা দেন। বাঙালীদের সুখনিদ্রা ও স্বপ্নভঙ্গ হয়। মুহূর্তেই তাদের চেহারা পাল্টে যায়। তারা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে এবং রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ জনতা অনেক স্থানে ভাংচুর চালায়, এমনকি পাকিস্তানের জাতির পিতার ছবি ও পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ছুটতে থাকে হোটেল পূর্বাণীর দিকে, যেখানে দলীয় মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করছিলেন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিক্ষুব্ধ এই মানুষদের তিনি শান্ত হতে, ৩ মার্চ থেকে সারাদেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল ও ধর্মঘট পালন এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে পরবর্তী করণীয় জেনে আসার আহ্বান জানান। ৭ মার্চ সেদিন ছিল রবিবার। শীত বিদায় নিয়েছে, তারপরও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। বর্তমানের তুলনায় তখন এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বেশ অনুন্নত। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে মানুষ মরছে, চারদিকে অস্থিরতা, টানটান উত্তেজনা। বোধ করি হাজার বছরের পরাধীন, নিরীহ একটি জাতি বাঙালীরা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে উপস্থিত। কখন কি হয়ে যায় বলা মুশকিল এমন অবস্থা। তাতে কি! তারপরও সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ চলমান। বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কার, ট্রেন-লঞ্চ-স্টিমার-নৌকা সব রকমের বাহন যেখানে পূর্ণ, সেখানে সকাল থেকে হেঁটে ঢাকার দিকে ছুটছে মানুষ। খাল-বিল-নদীর স্রোতধারা যেমন ধাবিত হয় সাগরের পানে, তেমনি মানুষ ছুটছে ঢাকা অভিমুখে। ঢাকা শহরে প্রবেশের সকল পথ ধরে যানবাহনের পাশাপাশি পিঁপড়ার মতো এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের মিছিল আর মিছিল। লক্ষ্যস্থল ঢাকা রেসকোর্স ময়দান। এরা কেউই ভাড়াটে পাবলিক কিংবা কোন নেতা-নেত্রীর চাটুকার নয়, মিডিয়াতে মুখ দেখান কিংবা ছবির প্রতি এদের বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ নেই। মনের টান, উচ্ছ্বাস, সর্বোপরি দেশের প্রতি যে ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ এদের হৃদয়ে জাগিয়ে দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান সেটিই এদেরকে তাড়িত করছে। সেদিন নিতান্তই এক কিশোর ছিলাম; কিন্তু সচেতন ও এই দৃশ্যের চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি বাংলাদেশের এমন কোন জেলা, মহকুমা, থানা কিংবা গ্রাম ছিল না যে, ঢাকায় তার প্রতিনিধি পাঠিয়ে ঐ ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার গৌরব অর্জন করেনি। ঢাকার এমন কোন পাড়া-মহল্লার অলি-গলি, কাঁচা-পাকা রাস্তা ছিল না যার বুকের ওপর দিয়ে রেসকোর্সগামী উন্মত্ত জনতার মিছিল এগিয়ে যায়নি। সকলেই উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ, তারপরও ঈদের আনন্দ চারদিক। মিছিলে মিছিলে মুখরিত পুরো ঢাকা শহর কাঁপছিল। সুন্দরবন যেন এই পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ায় চারদিকে কেবল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন। এই জনপদে এমন দৃশ্য কোন জনমেই দেখেনি কেউ। যারা কখনোই ঢাকা শহরে আসেনি এমন সংখ্যাধিক্য মানুষ যুদ্ধ জয়ের আনন্দ ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃপ্ত পদক্ষেপে কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান তুলে এগিয়ে চলেছে রেসকোর্সের দিকে যেখানে লিখিত হতে যাচ্ছে একটি জাতির ভবিষ্যত, বাঙালীর ইতিহাস। এরা সবাই সাক্ষী হতে যাচ্ছে গৌরবময় নতুন ইতিহাসের। পঠিত হবে শ্রেষ্ঠ কবিতা- হাজার বছর যাবত যে কবিতার জন্য উন্মুখ হয়েছিল এদের পূর্ব পুরুষরা। আজ সেই কবিতা শোনার সৌভাগ্য হবে তাদেরই উত্তরাধিকারীদের। সেই কবিতা শুনে তারা ধন্য হতে চায়, কর্ণ জুড়াতে চায়। কেবল যে ঢাকায় উপস্থিত জনতা তা নয়। সমগ্র বাঙালী জাতিকে এই সৌভাগ্যের অংশীদার করার জন্য ঢাকা রেডিও-টিভির বাঙালীরা রেসকোর্স থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের আয়োজন করেছে, যা ইতোপূর্বে কখনও হয়নি। দুপুরের অনেক আগেই রেসকোর্স ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী বড় বড় গাছ, অট্টালিকার ছাদ ভরে গেছে মানুষে। চারদিক থেকে ঢেউয়ের মতো মিছিলের পর মিছিল এসে মানুষের ভিড়ে যেখানেই বাধা পাচ্ছে সেখানেই স্থান করে নিচ্ছে। প্রধান সড়ক-অলি-গলিতে শুধুই মানুষ আর মানুষ। এ যেন মানুষের সমুদ্র, যার শুরু ও শেষ কোথায় খালি চোখে তো নয়ই, বোধ করি বৈজ্ঞানিক কোন যন্ত্র দিয়েও তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এমন সময় একটি হেলিকপ্টার মাথার ওপর দিয়ে কয়েক বার চক্কর দিলে এই জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ মানুষ হাতের লাঠি উঁচিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগানে তাদের ক্ষোভ জানিয়ে দিল। এরা নিশ্চিতভাবে সাহসী ও দেশপ্রেমিক; কিন্তু অপরিণামদর্শী। মৃত্যুকে এরা পরোয়া করে না। আর তাই তো বাঁশের লাঠি, রড নিয়ে এরা ঢাকায় এই জনসমুদ্র উপস্থিত হয়েছে। নেতা মুজিব নির্দেশ দেয়া মাত্র গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে পাকিস্তানের সকল দুর্গ। বিকেল ৩টার কিছু পর সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এমনই সময় স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় ভিড় ঠেলে সুউচ্চ মঞ্চে উঠে এলেন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপর হাফহাতা কালো কোট পরিহিত এ যাবতকালের এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সুন্দর মুখশ্রীর রাজনীতিক, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, সুঠাম দেহের অধিকারী, আত্মপ্রত্যয়ী, সাহসী, আপদমস্তক খাঁটি বাঙালী পুরুষ, যার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে পূর্ব পুরুষ বাগদাদ থেকে ২শ’ বছর পূর্বে আগত শেখ বোরহান উদ্দিনের রক্ত, নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তারুণ্যের সেই দিনগুলো থেকে বাঙালীর মুক্তির স্বপ্ন ধারণ করে যিনি সমুদ্রের সকল ঝড়-ঝাপটা, উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে এইমাত্র উপকূলে হাজির। তার এবং একমাত্র তারই প্রেরণা ও ডাকে অন্য কারও নয়- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, জকিগঞ্জ-গোয়াইনঘাট থেকে শ্যামনগর, কলাপাড়া অবধি শুরু হয়েছে অগ্ন্যুৎপাত। আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে যেন বেরিয়ে আসছে কোটি কণ্ঠের আওয়াজ ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো। শেখ মুজিবের পথ ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ উত্তাল এই জনসমুদ্রে আজ সমবেত হয়েছে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদহীন নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা-কিশোর। এসেছে কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমার-তাঁতী-ড্রাইভার-রিকশাচালক-ছাত্র-শিক্ষক-উকিল-মোক্তার-ডাক্তার-চাকরিজীবী-হকার-ভিক্ষুকসহ সকল পেশা ও পথের মানুষ। শুধু তাই নয়, খোদ পাকিস্তান সরকারের ইউনিফর্মধারী বিভিন্ন বাহিনীর অনেক বাঙালী সদস্যও বেসামরিক পোশাকে মিশে গেছে সকলের সঙ্গে। তারাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাদের স্বজনদের সঙ্গে। এরা সবাই নিজ কানে শুনতে চায় মুজিবের পরবর্তী সিদ্ধান্ত, তার নির্দেশনা। কেননা তিনিই তাদের পথ প্রদর্শক। এটা যে শুধু এই জনসমুদ্রের দৃশ্য তা নয়, পুরো বাংলাদেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। নারী-পুরুষ যাদের বিশাল অংশ কখনও শেখ মুজিবকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তারপরও তিনি এদের অতি আপনজন। তাই বাড়িঘরের আঙ্গিনা, বাজার-দোকান-ক্লাবঘর, এর আশপাশে রাস্তায় রেডিও ট্রানজিস্টারের সামনে সমবেত হয়েছে এরা সকলে। যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ, পুরো বাংলাদেশ যেন থেমে গেছে। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে পুরো দেশটাতেই একটি জনসভা। এই জনসভার একমাত্র বক্তা শেখ মুজিবুর রহমান, যেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক। কিন্তু কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে মুজিব যে ক্রস রোডে এসে দাঁড়িয়েছেন এখান থেকে তিনি কোন্ দিকে পা বাড়াবেন, কি শোনাবেন? জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় এই দেশ ও জাতির জন্য তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। সহকর্মী অনেক জ্ঞানী-গুণী জাঁদরেল নেতা ভয়ভীতি কিংবা লোভ লালসার কারণে পথিমধ্যে কেটে পড়েছেন, হারিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি বিচ্যুত হননি নিজ লক্ষ্য হতে। আজ সেই মুজিবের দিকে তাকিয়ে আছে বাঙালী জাতি। তার যে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকে আজীবনের জন্য না হলেও শত বছরের জন্য পিছিয়ে দেবে। আবার দুর্বলতা প্রদর্শন জাতির মনোবল ও ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে। এমন একটি অস্থির ও বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে কোন প্রকার কাগজি সহায়তা ছাড়া স্বভাবসুলভ, সহজ ও সকলের বোধগম্য চলিত ভাষায় আঠারো মিনিটের জ্বালাময়ী যে বক্তৃতা তিনি করলেন তা বাংলাদেশে এ পর্যন্ত একটিও নয়, আগামীতে তেমন আর হওয়ার কোন সম্ভাবনা ও কারণও নেই। তাই তো ৪৭ বছর পর আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বীকৃতি দিলেও সত্যিকার অর্থে তেমন উল্লসিত হতে পারিনি। কেননা, ৪৭ বছর পূর্বেই তো এই ভাষণটি নিজে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দু-চারটি ভাষণের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। ‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন করে নিজস্ব স্টাইলে জাদুকরের ন্যায় আঠারো মিনিট তিনি যেভাবে পুরো একটি জাতিকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন জানি না পৃথিবীর অন্য কোন নেতা বা কবি তা কখনও পেরেছেন কিনা। তার এই আঠারো মিনিটের নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেকটি বাক্য, কণ্ঠের উত্থান-পতন সবই ছিল চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণীয়, মনোমুদ্ধকর এবং সময়োপযোগী। তার আশঙ্কা ছিল যে কোন সময় তাকে আটক কিংবা হত্যা করা হতে পারে। মৃত্যুতে তার ভয় নেই; কিন্তু তার জনগণের সম্মুখে যে তিনি আর উপস্থিত নাও হতে পারেন। অতঃপর এমন কোন কথা অব্যক্ত রাখলেন না যেন আক্রান্ত হলে নেতার অনুপস্থিতিতে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে তাদের বেগ পেতে হয়। নিজে এবং জাতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ দেয়ার সুযোগ না রাখলেও প্রকাশ্যে অথচ কৌশলে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধই যে হবে একমাত্র পথ তা বাতলে দিয়ে তার অনুপস্থিতিতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে এবং রাস্তাঘাট বন্ধ করে মূলত শত্রুর এল অব সি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। যে মানুষটিকে এতদিন সকলে কেবল তাদের আপোসহীন সাহসী নেতা হিসেবে জেনে এসেছিল, সেই তিনি আজ গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞ সেনাপতিরূপে আবির্ভূত হলেন। তার মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল যেন বন্দুকের নল থেকে এইমাত্র বেরিয়ে যাওয়া এক একটি তপ্ত বুলেট। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আকাশ কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই বজ্রকণ্ঠ। এরই উন্মাদনায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে উঠেছিল ঝড়। ৪৭ বছর পর তার সেই ভাষণ আজও ষাটোর্ধ বৃদ্ধের রক্তে উত্তাপ ছড়ায়, শিহরণ জাগায়। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে কণ্ঠের সকল শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ তার এই ঘোষণা, মুক্তির বাণী সকলের হৃদয়ে গেঁথে যায়। মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে, তৃপ্ত হৃদয়ের ঘরে ফিরে যায়। সেইদিনই সরকার তার ভাষণ প্রচার করতে না দিলেও পরদিন সকালে রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তা প্রচারে বাধ্য হয়। হাজার বছর যাবত যে জাতি পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিল সেই জাতি তাদের নেতার কণ্ঠে এমন ঘোষণায় পরবর্তী করণীয় কি তা বুঝে ফেলল। সেদিন থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কাগজ-কলমে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট থাকলেও পূর্বাঞ্চলে শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেদিন থেকে তার নির্দেশে একদিকে অসহযোগ আন্দোলন, অপরদিকে গ্রাম-গঞ্জ-শহরে প্রকাশ্যে চলছিল গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। ফলে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বাঙালীরা সহসাই রুখে দাঁড়িয়েছিল। নিরস্ত্র জাতি হয়েও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত এবং মাত্র নয় মাসে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিল, যা পৃথিবীর ইতিহাসে একটিও নেই। আমাদের ছোট বেলা থেকে আমরা আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, চার্চিল, সুভাষ বসুর মতো নেতাদের বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি ঈশ্বর প্রদত্ত বাণীর মতো জ্ঞান করে আসছি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ৭ মার্চে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মর্মার্থ ও গুরুত্ব ’৭১ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যথার্থভাবে আমরা পৌঁছে দিতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণ দেশে-বিদেশে যতবার প্রচারিত হয়েছে আমি নিশ্চিত পৃথিবীর কোন নেতার ভাষণ এতবার প্রচার হয়নি। তারপরও বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে কেন ৪৭টি বছর লেগে গেল! সৎ ও সত্যবাদী মানুষ মাত্রেই তো জানে ১৯৭১ -এ রণাঙ্গনের অনুপ্রেরণা ছিল তার ৭ মার্চের ভাষণ, তার সেই বজ্রকণ্ঠ। তারপরও কেন এই ভাষণের পক্ষে ও বিপক্ষে বাঙালী, এমনকি সেদিনের মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত হবে? সবাইকে যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে হবে এমনটি নয়। কিন্তু সব দলের লোকই তো জানে যে, ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থে বাঙালী জাতিকে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের হৃদপি-ে, তাদের মস্তিষ্কে, তাদের রক্ত কণিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতার পক্ষে একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকেও এর চেয়ে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেয়া কখনোই সম্ভব ছিল না। অতএব স্বীকার করতেই হবে, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালীর একমাত্র নেতা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান গাইড, সেনাপতি। ৪৭ বছর পরও পরাজিত শক্তি পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। তাদের পরাজয়ের জন্য মুজিবকেই দায়ী করে। সেটাই স্বাভাবিক। একই কারণে সেই শক্তি দেশে অস্থিতিশীলতা ও সর্বদা বিভেদ সৃষ্টি করবে। তাদের এই অপতৎপরতা ব্যর্থ করে দিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে শাণিত করতে হবে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মস্তিষ্কে, রক্তে সঞ্চারিত করতে হবে। এই ভাষণই হবে আগামী দিনের সকল প্রেরণার উৎস, যা কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শক্তি ও সাহস জোগাবে। লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
×