ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়রি

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়রি

জনতার ঢল ২ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের কফিন আর্মি স্টেডিয়ামে নেয়া হয় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। স্টেডিয়ামের সব গেট দিয়ে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো প্রবেশ করতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সেনাবাহিনী সদস্যদের সহযোগিতায় একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা এবং কর্মীরা আনিসুল হকের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিকেল পৌনে ৪টায় আছরের নামাজের জন্য আজান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে নামাজের জন্য সারিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিকেল ৪টায় আছরের নামাজ শেষে কয়েক মিনিট বিরতি দিয়ে সেখানেই জানাজা পড়া হয়। জানাজার আগে সেখানে উপস্থিত সর্বস্তরের মানুষের উদ্দেশে আনিসুল হকের ছেলে নাবিদুল হক আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিস্বার্থে তিনি কাউকে দুঃখ দেননি। তবে মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জনস্বার্থে তিনি হয়ত কারও মনে দুঃখ দিয়ে থাকতে পারেন। এজন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’ নাবিদুল হকের আবেগঘন বক্তব্য শুনে আর্মি স্টেডিয়ামে উপস্থিত সবাই তার প্রশংসা করলেন। মন্তব্য করতে থাকলেন যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। এরকম শোকের দিনে যেভাবে বাবার মতো গুছিয়ে কথা বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তা সত্যই বিরল। চেষ্টা থাকলে একদিন আনিসুল হকের মতোই অনেক বড় মাপের মানুষ হবে নাবিদুল হক । জানাজা শেষে স্টেডিয়ামে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষ আনিসুল হকের কফিনের সামনে যেতে থাকে। শুরু হয়ে যায় লাশ দেখার জন্য হুড়োহুড়ি। কে কার আগে লাশ দেখবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছিল। এক পর্যায়ে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি-ঠেলাঠেলি। ছবি তোলার জন্য গণমাধ্যমের ক্যামেরাপার্সনদের হুড়োহুড়ি ছিল আরও বেশি। এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনা সদস্যরা বারবার লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে সবাইকে লাশ দেখার অনুরোধ জানান। কিন্তু কে শোনে কার অনুরোধ। আবেগাপ্লুত মানুষ কোন বাধাই মানতে চায়নি। জনপ্রিয় মেয়র ও প্রিয় মানুষ আনিসুল হককে শেষবার দেখার জন্য তাদের এই ছুটে চলা। এক পর্যায়ে আনিসুল হকের ছোট ভাই ও সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক এবং ছেলে নাবিদুল হক সবাইকে সুশৃঙ্খল থেকে লাশ দেখার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু জনতার বাঁধভাঙ্গা আবেগ তাদের অনুরোধকে ছাপিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে আনিসুল হকের লাশ প্রজেক্টারের মাধ্যমে দেখানোর ব্যবস্থা করে সবাইকে সেদিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানান। এ সময় মানুষের হুড়োহুড়ি কিছুটা কমে আসে। পরে কফিন বন্ধ করে দাফনের জন্য বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কবরস্থানে যাওয়ার পথে লাশবাহী কনভয়ের পেছনে আবার মানুষের স্রোত, বাঁধভাঙ্গা ঢল। এই ঢল থেকেই প্রমাণ হয় নগরবাসীর কাছে আনিসুল হক জনপ্রিয়তার কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন! শরীফুল ইসলাম ভাল লাগার ট্রেন ভ্রমণ... ১০ নবেম্বর ২০১৭, শুক্রবার। গন্তব্য ঢাকা থেকে সিলেট। রাত ৯টা ৫০ মিনিটে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা উপবন এক্সপ্রেস। অফিস শেষ করে ভাবছিলাম সাড়ে ৯টার দিকে স্টেশনের দিকে রওনা হলেই চলবে। ভাবার কারণ, ট্রেন তো আর নির্ধারিত সময়ে ছাড়বে না! কমপক্ষে আধাঘণ্টা বা এক ঘণ্টা বিলম্ব হবেই! পরক্ষণে ভাবলাম, বলা তো যায় না। যদি ছেড়ে যায়। একটু আগেই বের হই। ইস্কাটনের জনকণ্ঠ ভবন থেকে রাত ৯টায় বের হলাম। ৯টা ২৫ মিনিটেই কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাই। হাতে ২৫ মিনিট সময় পাওয়ায় রাতের খাবার খেলাম হোটেলে। ৯টা ৪৫ মিনিটে প্লাটফর্মে পৌঁছামাত্রই স্টেশনের মাইকে ঘোষণা ‘সিলেট অভিমুখী উপবন এক্সপ্রেস আর কিছুক্ষণের মধ্যে ৬ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাবে।’ কিছুটা অবাক হলেও বিস্মিত হলাম না। বরং মনটা ভরে উঠল। এক সময় ট্রেনে যাত্রা মানেই ছিল সময়ের কোন ঠিক নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। অথচ এখন সেই ধারণা আমূলে পাল্টে গেছে। এটাও উন্নয়নের একটা নমুনা বলা যায়। হাতে একদমই সময় নেই, তাই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে আমার নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম। অবাক হলাম যখন ট্রেন নির্ধারিত সময়েই স্টেশন ছাড়ল, এক মিনিটও বিলম্ব হলো না। ট্রেন ছাড়ার আগে হুইসেল দিতে আর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। এ সময় অদ্ভুত এবং মজার দৃশ্য বোধ হয় প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার সময়ই হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। দেখলাম প্রায় ১০-১২ জন ট্রেনে ওঠার জন্য বিদ্যুতগতির দৌড় দিয়েছেন। দৃশ্যটা দেখে অনেক কিছুই ভাবনায় আসে। দৌড়ানোর দৃশ্য দেখে একজন যাত্রী বললেন, ‘এটা যেন নিয়ম। ট্রেন ছাড়বে আর কিছু মানুষ দৌড়াবে না, এটা হতেই পারে না। এমন চলতেই থাকবে।’ আরেকজন বললেন, ‘আমরা আমাদের মানসিকতা পাল্টাতে পারিনি। তা না হলে এমন হবে কেন? সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী চললে প্রায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিছু বিশৃঙ্খল মানুষের জন্য শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়।’ সময়মতো যাত্রা শুরু হওয়ায় বেশ স্বস্তি পেলাম। কারণ সকালে সিলেটে পৌঁছে কাজ সেরে রাতের ট্রেনেই ফিরতে হবে। রীতিমতো টাইট শিডিউল। যাত্রাপথে অনাকাক্সিক্ষত কারণে বিলম্ব হলে বিড়ম্বনার সীমা থাকবে না। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত, আসা-যাওয়া নির্বিঘ্নে ই করতে পারি। নিজের আসনে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করেছি। তন্দ্রাভাবও এসে গেছে। এরই মধ্যে মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ভাই এটা আমার সিট, আপনি উঠেন! আমি তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করে তাৎক্ষণিক ভাবলাম, আমি তো দেখেশুনে সঠিক জায়গাতেই বসেছি। তাহলে উনি বলছেন কেন। নিশ্চিত উনার ভুল হচ্ছে। আমি বললাম, আপনার কোন্ বগি, সিট নম্বর কত? উনি তেজ দেখিয়ে বললেন, আমার সব ঠিক আছে, এটাই আমার সিট। আমার পাশে বসেছিলেন এক যুবক। বিষয়টি বুঝতে পেরে সে লোকটিকে বলল, আঙ্কেল আপনার টিকেটটা দেখি। তবু দেখাতে রাজি হলেন না। উপায় না দেখে আমার টিকেট বের করলাম। এরপর দুজন মিলিয়ে দেখলাম আমি ঠিক জায়গাতেই আছি। তখন পাশে বসা যুবক লোকটিকে কড়া ভাষায় বললেন, ‘দেখি আপনার টিকেট।’ এবার বাধ্য হলেন পিছু হঠতে। লোকটিকে দেখে আমাদের দুজনেরই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। বগি ভুল করে উনি এসে আবার মেজাজ দেখাচ্ছেন! এতক্ষণে আশপাশের অনেকেই বিষয়টি খেয়াল করেছেন। আমাদের বলতে হলো না কিছুই। পাশের এক ভাই বললেন, ‘আপনি যান তো এখান থেকে। সেই কখন থেকে বিরক্ত করছেন। নিজের সিট খুঁজতে পারেন না ঠিকমতো, অথচ অন্যকে এসে বিরক্ত করছেন। আপনাদের মতো কা-জ্ঞানহীনদের জন্যই ভ্রমণের শান্তি নষ্ট হয়।’ কি আর করা, কাঁচুমাচু করে সরি বলে দ্রুত চলে গেলেন লোকটি। এরপর আরেকজন বললেন, সবে তো শুরু ভাই, পথে আরও কত কি দেখবেন। তবে বাকি পথে আর সমস্যা হয়নি। অনেকটা আরামেই ভোরে সিলেট পৌঁছে যাই। এরপর শাহপরানে যাই বোনের বাসায়। সারাদিনের কাজ সেরে রাত ৯টায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছে যাই। উল্লেখ্য, অনলাইন সিস্টেমের কারণে আমি ঢাকা থেকেই ফিরতি টিকেট কেটে রেখেছিলাম। রাত ১০টায় সিলেট থেকে উপবন এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা। এবার অবশ্য ঢাকার মতো নির্ধারিত সময়ে ছাড়েনি ট্রেনটি। ছাড়ল ৪০ মিনিট পর। দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তার কাছে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলাম। উনি বললেন, কিছু সংস্কার কাজ ছিল, তাই দেরি। তবে যাত্রা শুরু হলে সেটা পুষিয়ে নেয়া হবে। এই কর্মকর্তার কথা শুনে বেশ ভাল লাগল। ভোরে সময়মতো কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে সে প্রমাণও পেলাম। ভাললাগা, তৃপ্তি নিয়ে শেষ হল স্বস্তির ট্রেন ভ্রমণ। জাহিদুল আলম জয় [email protected]
×