ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কারণ দর্শানোর জবাব দিয়েছে ২৬ ব্যাংক

ডলারে টালমাটাল মুদ্রাবাজার

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭

ডলারে টালমাটাল মুদ্রাবাজার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মুদ্রাবাজারের কিছুতেই অস্থিরতা কমানো যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের টাকার মান কমছেই। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে সোমবার প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮২ টাকা ৩০ পয়সা, যেখানে এক মাস আগে লাগত ৮০ টাকা ৮০ পয়সা, এক বছর আগে খরচ করতে হতো ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। সাধারণ ক্রেতা পর্যায়ে ৮২ টাকা ৩০ পয়সা দিয়েও ডলার মিলছে না। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে দুই থেকে আড়াই টাকা করে বেশি নিচ্ছে। গত মাসের শেষ দিকে তা ৮৫ টাকাতেও ওঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে ঘোষিত বিনিময় হার মেনে না চলায় সোমবার কারণ দর্শানোর জবাব দিয়েছে ২৬টি ব্যাংক। এখন জবাব পর্যালোচনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জবাব সন্তোষজনক না হলে একটি ব্যাংককে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিনই ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবারও দেড় কোটি ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক ডলারও কেনেনি; চলতি অর্থবছরে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৭১ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত এক মাসে ডলারের বিপরীতে ২ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে বাংলাদেশের টাকা; এক বছরে কমেছে সাড়ে ৪ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার এই দরপতনে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও আমদানি খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে পণ্যমূল্য। ভারতের মুদ্রা রুপি, চীনের ইউয়ান, রাশিয়ার রুবল আর ইউরো জোনের ইউরোর যখন বড় দরপতন হয়েছিল, তখন টাকার মান ‘স্থিতিশীল’ ছিল। বিশ্ববাজারে এসব মুদ্রার মান এখন স্থিতিশীল হলেও বাংলাদেশের টাকা গত ছয় মাস ধরেই দুর্বল হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সরঞ্জামের আমদানি বেড়েছে। আমদানি খরচ মেটাতে ডলারের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে ‘স্বাভাবিক কারণেই বাড়ছে ডলারের বিনিময় হার। তবে ডলারের দরের এই ঊর্ধ্বগতি যে পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়, তা ধরা পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতে ব্যাংকগুলো ডলারের যে মূল্য দেখিয়েছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তার চেয়ে ২ থেকে আড়াই টাকা বেশি রাখা হাচ্ছিল। এতে করে বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়। আর ব্যাংকগুলো মুনাফা বাড়াতে ডিসেম্বরের মধ্যেই সব আমদানি নিষ্পত্তি করতে চায়। মূলত বছর শেষে ভালো মুনাফা করতেই তাদের এ প্রবণতা। এদিকে খাদ্য ও অবকাঠামো নির্মাণ পর্যায়ে আমদানি ব্যয়ও হঠাৎ বেড়ে গেছে। এভাবে প্রকৃত দর গোপন করে মিথ্যা তথ্য দেয়ায় কেন তাদের জরিমানা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংক এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনসহ মোট ২৬টি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার ছিল জবাব দেয়ার শেষ দিন। সবগুলো ব্যাংকই জবাব দিয়েছে। এখন সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যাদের জবাব সন্তোষজনক হবে না তাদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ (২) ধারা লঙ্ঘনের দায়ে একটি ব্যাংককে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর বাজার নিয়ন্ত্রণে জরুরি বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নেতারা। সভায় ঘোষিত দামেই ডলার বিক্রি করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়। বাফেদার চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদার কারণেই এ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। যা ভুল হওয়ায় হয়ে গেছে। এখন সব ব্যাংককে বলা হয়েছে, ঘোষিত দামে ডলার বিক্রি করতে। এতে সবাই একমত হয়েছে। ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বাজারে নজর রেখেছেন এবং চাহিদা অনুযায়ী ডলার ছাড়ছেন। ব্যাংকগুলো যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রি না করে সেটাও তদারকি করা হচ্ছে। এদিকে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নবেম্বর সময়ে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৫৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। আর অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। এই চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের মতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১২ সালে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ৮৫ টাকায় পৌঁছেছিল। তিন বছরে সেই দর কমে ২০১৫ সালের অগাস্টে নেমে এসেছিল ৭৭ টাকা ৪০ পয়সায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ডলারের দর ৮০ টাকার নিচেই ছিল। জুলাই থেকে তা বাড়তে শুরু করে; অক্টোবর-নবেম্বরে বাড়ার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ডলার-টাকার বিনিময় হার ঠিক করে দিত; সে দরেই ডলার লেনদেন হতো। তার বদলে ২০০৩ সালে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয় বাংলাদেশে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। তবে তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে টাকা-ডলারের বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করেছে।
×