ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

স্মরণে নৃত্য গুরুমাতা রাহিজা খানম ঝুনু

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

স্মরণে নৃত্য গুরুমাতা রাহিজা খানম ঝুনু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাকিস্তান আমলে পায়ে নূপুর জড়িয়ে ভেঙ্গেছিলেন অচলায়তন। অবরোধবাসিনীর জীবনকে উপেক্ষা করে হয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী। নাচের আশ্রয়ে এগিয়ে গেছেন সংগ্রামমুখর প্রগতির পথে। হয়েছেন দেশের নৃত্যশিল্পের পথের দিশারী। সম্প্রতি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন নৃত্যগুরুমাতা খেতাবপ্রাপ্ত সেই শিল্পী রাহিজা খানম ঝুনু। দেশের নৃত্যাঙ্গনের সবার শ্রদ্ধাভাজন সেই শিল্পীকে স্মরণ করা হলো সোমবার। বরেণ্য এই শিল্পীর প্রতি নৃত্যশিল্পীসহ সংস্কৃতির নানা ভুবনের মানুষেরা জানালেন ভালবাসা। গানের সুরে তার প্রতিকৃতিতে অর্পণ করা হলো পুষ্পাঞ্জলি। শিল্পী, সংগঠক ও মন্ত্রীর কথায় উঠে এলো তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা অধ্যায়। হালকা শীতমাখা হেমন্তের বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত আঙিনায় এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘নয়নসম্মুখে তুমি নাই/নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’ প্রতিপাদ্যে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। আয়োজনের শুরুতেই পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। সেই নীরবতার মাধ্যমে একসঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, লোকসঙ্গীত শিল্পী বারী সিদ্দিকী ও নৃত্যশিল্পী রাহিজা খানম ঝুনুকে। নীরবতা শেষে ঝুনুর প্রতিকৃতিতে প্রদীপ প্রজ্বালনের পাশাপাশি নিবেদন করা করা পুষ্পাঞ্জলি। এ সময় নেপথ্যে ভেসে বেড়ায় ‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা’ গানের সুর। একে একে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান সংস্থার সভাপতি মিনু হক, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান, আমানুল হক, শামীম আরা নীপা, সাদিয়া ইসলাম মৌ, মুনমুন আহমেদসহ অনেকে। এছাড়া বিভিন্ন নৃত্য সংগঠনের পক্ষ থেকেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। স্মরণসভায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, নৃত্যশিল্পী হিসেবে রাহিজা খানম ঝুনু নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেছিলেন। সেখানে ছিল তার অসংখ্য ভক্ত, অনুসারী ও শিষ্য। তার এমন শ্রদ্ধার কারণ হচ্ছে, তিনি পাকিস্তান আমলে প্রতিকূল পরিবেশে নৃত্যচর্চা শুরু করেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজের সংস্কার ও রাষ্ট্রের বাধাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন আপন পথে। এ কারণেই পুরনোদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা স্মরণে রাখবে এই পথিকৃৎ শিল্পীকে। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি রক্ষায় সরকারী পদক্ষেপ বিষয়ে রাহিজা খানম ঝুনুর মেয়ে ফারহানা চৌধুরী বেবীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমির পুরনো ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় নেয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে তার আগের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার সকল পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর কথায় উঠে আসে নৃত্যশিল্পী ঝুনুর প্রতিকূলতায় আবদ্ধ প্রারম্ভিক জীবনের কথা। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে রাহিজা খানম ঝুনুর বন্ধুত্বের বয়স প্রায় ৬০ বছর। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানী সামরিক শাসনামলে যখন নৃত্যনাট্য নক্সী কাথার মাঠ নির্মিত হচ্ছে সেই সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী চেয়েছিল ওই নৃত্যনাট্যটি যেন মঞ্চস্থ না হয়। আর সেই নৃত্যনাট্যের সাজু নামের চরিত্রটির রূপায়ন করেছিল ঝুনু। জিএ মান্নানের নির্দেশিত নৃত্যনাট্যটির জন্য নাচের পাশাপাশি অভিনয়ও রপ্ত করতে হয়েছিল ঝুনুকে। আর ওই নৃত্যনাট্যের রচয়িতা কবি জসীম উদ্্দীন ঝুনুকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তোর জন্যই বোধ হয় আমি সাজু চরিত্রটি সৃষ্টি করেছি’। একজন নৃত্যশিল্পীর জন্য এর চেয়ে বড় মূল্যায়ন আর কি হতে পারে? নৃত্য ও অভিনয়ের অনবদ্য সম্মিলনে চরিত্রটি রূপায়ন করেছিলেন ঝুনু। তিনি চলে গেলেও আপন কীর্তির আলোয় বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। স্মরণসভায় নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক ঘোষণা দেন, আগামী ২৯ এপ্রিল বিশ্ব নৃত্যদিবসের অনুষ্ঠানে রাহিজা খানম ঝুনুর নামাঙ্কিত পুরস্কার প্রদান করা হবে একজন শিল্পীকে। লায়লা হাসান বলেন, রাহিজা খানম ঝুনুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আত্মিক। তাই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন ও থাকবেন। সরল ও শিশুর মতো ছিল তার মনটি। মাতৃস্নেহে সবাইকে আপন করে নিতে পারার কারণেই তিনি নৃত্যগুরুমাতা হতে পেরেছেন। নন্দিত নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা বলেন, তিনি হচ্ছেন এমন একজন শিল্পী যাকে নিয়ে খুব বেশি বলার চেয়ে অনুভব করাটাই বড় বিষয়। আমরা হাজার চেষ্টা করলেও সরল এই মানুষটির মানবিকতাকে ছুঁতে পারব না। তবে তার মতো হওয়ার চেষ্টাটা করতে পারব। তাই তিনি শুধু নাচের জন্য নন একজন বড় মাপের মানুষ হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের কাছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, রাহিজা খানম ঝুনুর একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে দেশের নৃত্যাঙ্গন। দেশের নৃত্যশিল্পের বর্তমানের অবস্থানটির পেছনে রয়েছে তার মতো শিল্পীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই শিল্পী পাকিস্তান আমলে শত প্রতিকূলতার ভেতরেও নৃত্যচর্চা করেছেন নির্ভীক চিত্তে। এছাড়াও স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, লায়লা হক প্রমুখ।
×