ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপ্রিয় হলেও অগ্রিম সত্য কথা বলতেন শেখ মনি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

অপ্রিয় হলেও অগ্রিম সত্য কথা বলতেন শেখ মনি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনির ৭৮তম জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্টজনরা বলেছেন, শেখ ফজলুল হক মনি সব সময় অপ্রিয় সত্য কথা বলতেন; যা সঠিক ও সত্য ছিল। এসব কথা বলার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা লিখতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তিনি বলেছিলেন, বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবেই। সেই প্রতিবিপ্লবী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি এখনও সক্রিয়। এদের ষড়যন্ত্রও অব্যাহত। দেশ ও জাতিকে রক্ষায় এদের বিরুদ্ধে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে, সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সোমবার রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র মাঠে শেখ ফজলুল হক মনির ৭৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই জন্ম‍াৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য এই জন্মৎসবে আলোচনা পর্ব ছাড়াও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং শেখ মনির বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্মের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। মনোরম সাজসজ্জার পাশাপাশি ১০ হাজার মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয় সেখানে। এদিকে শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মরণসভা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলসহ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেখ মনির জন্মবার্ষিকী পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। শহীদ শেখ মনির ছেলে ও ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, এ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ এমপি, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপি, মীর শওকাত আলী বাদশা এমপি, আবদুল আওয়াল এমপি, সাংবাদিক-কলামিস্ট কামাল লোহানী, সাবেক বিচারপতি আফম মেজবাহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। এর আগে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া জৎসবে শেখ মনির জন্মবার্ষিকীর কেক কাটেন অতিথিরা। এরপর শেখ মনির ওপর নির্মিত থিম সং ছাড়াও দেশাত্মবোধক ও গণসঙ্গীত এবং নৃত্য পরিবেশিত হয়। আবৃত্তি পরিবেশন করেন দেশের খ্যাতনামা আবৃত্তিকার ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়। জন্মোৎসবের অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে কলাবাগান মাঠসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, খুব সাহসী ও আপোসহীন নেতা ছিলেন শেখ মনি। জাতির পিতার মতো তার মধ্যেও ভয়ভীতি ছিল না। তিনি তার লক্ষ্যে ছিলেন অটল। অনেকের ভাল না লাগলেও তিনি অপ্রিয় সত্য ও সঠিক কথাই বলতেন। সপরিবারে জাতির পিতা হত্যাকা-ের সময় খুনিরা তাকেই প্রথম হত্যা করেছিল। কারণ বেঁচে থাকলে তিনিই একমাত্র প্রতিরোধ করতে পারতেন। তিনি বলেন, জীবদ্দশায় শেখ ফজলুল হক মনি অনেক কিছু লিখেছিলেন। অনেক সময় অপ্রিয় সত্য কথা বলতেন। তাৎক্ষণিক হয়ত কারও ভাল লাগত না। কিন্তু কথাগুলো সঠিক, সত্য ছিল। এসব কথা বলার ব্যাপারে উনি ছিলেন আপোসহীন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন। তিনি তা লিখতেন। তার লেখার তুলনা হয় না। তাই শেখ মনি শারীরিকভাবে চলে গেছেন। কিন্তু তার মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বাংলার মানুষের হদয়ের মণিকোঠায়। শেখ মনির ছোট ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণায় দেশ পরিচালিত হয়েছে। আজ যদি বঙ্গবন্ধু ও শেখ মনি ভাই বেঁচে থাকতেন তাহলে অনেক আগেই দেশ উন্নত-সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু দেশবিরোধী অপশক্তি ও প্রতিবিপ্লবীরা ২১ বছর ক্ষমতায় থাকায় দেশ ৫০ বছর পিছিয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব হয়। স্বাধীনতার পর হঠাৎ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে জাসদের উদ্ভব হলে স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে। এদের একজন এখনও আমাদের মন্ত্রিসভায়। এই প্রতিবিপ্লবী আর স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলে আঘাত করবে; এটি জানিয়ে শেখ মনি ভাই বঙ্গবন্ধুকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বিশ্বের কোথাও স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করতে পারে না। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। প্রতিবিপ্লবীরা এখনও ষড়যন্ত্র করছে। পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণা ভাঙ্গতে অনেক সময় লাগবে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসায় কিছুটা ভাঙ্গতে পেরেছেন। কিন্তু এখনও তারা সক্রিয়। এদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। তাই স্বাধীনতাবিরোধীরা আর যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, শেখ মনির মধ্যে সাহসিকতা, বলিষ্ঠতা ছিল। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তেমনি সাংবাদিকতাকেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করেছেন। বিরোধী দলের নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বের মধ্যে সুদৃঢ়তা, বলিষ্ঠতা, মেধা ও শিক্ষা ছিল। তার সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, কোথায় সফিউল্লাহ? সেনাবাহিনী প্রধান থাকা অবস্থায় সেদিন সফিউল্লাহ বিট্রে (বিশ্বাসঘাতকতা) করেছেন। আজ অনেকেই বড় বড় কথা বলেন। কিন্তু সেদিন মনি ভাইয়ের হাতে গড়া সংগঠন যুবলীগই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। বিচারপতি আফম মেজবাহ উদ্দিন বলেন, শেখ মনি কখনই কোন অন্যায় প্রশ্রয় দেননি। নীতির প্রশ্নে কোন আপোসও করেননি। তার মতো মেধাবী, দক্ষ ও সাহসী রাজনীতিবিদ আজকের রাজনীতিতে সত্যিই বিরল। ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস তার প্রয়াত বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বিপ্লবী চেতনা ও বিপ্লবের এক অগ্নিপুরুষের নামই হচ্ছে শেখ ফজলুল হক মনি। বিশে^র একজন বিপ্লবী চেতনার মানুষের সঙ্গেই তাকে মেলানো যায়। তিনি হচ্ছেন চে গুয়েভারা। সুতরাং, শেখ মনি ছিলেন বাংলার চে গুয়েভারা। যথাযোগ্য মর্যাদায় জন্মদিন পালন ॥ সোমবার ঢাকাসহ সারাদেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন সকালে শেখ মনিসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। দিনভর আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলসহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করা হয় শেখ মনির জন্মদিন। এ উপলক্ষে যুবলীগ সকালে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। পরে বনানী কবরস্থানে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনিসহ তার বাবা শেখ নুরুল হক ও মা আছিয়া বেগমের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও দোয়া-মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ।
×