ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল মানের মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা দশ ভাগেরও কম

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

ভাল মানের মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা দশ ভাগেরও কম

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশে ‘খুব ভাল’ মানের মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা এখনও ১০ শতাংশের কম! এক বছরে খুব ভাল স্কুলের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও সেই সংখ্যা এখনও দুই অঙ্কের কোটায়ও পৌঁছায়নি। খোদ সরকারের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনই বলছে, খুব ভাল মানের অর্থাৎ ‘এ’ ক্যাটাগরির স্কুলের সংখ্যা এখন এক হাজার ৬১৮। ‘বি’ ক্যাটাগরির মোটামুটি ভাল স্কুলের সংখ্যা এক বছরে সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৬৭তে। অন্যদিকে দুর্বল ও পুরোপুরি অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত ‘ডি’ ও ‘ই’ ক্যাটাগরির স্কুলের সংখ্যা এখন এক হাজার ৮৬। এর মধ্যে দুর্বল ডি ক্যাটাগরির স্কুল এক হাজার ৫৮ এবং ২৮ প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি অকার্যকর। যাকে বলা হচ্ছে ‘ই’ ক্যাটাগরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের স্কুলভিত্তিক সর্বশেষ স্ব-মূল্যায়ন প্রতিবেদনে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র নিয়ে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। দেশে ভাল মানের স্কুল বাড়ছে না- শিক্ষাবিদদের এমন উদ্বেগের মধ্যেই সরকারের মূল্যায়নে এ তথ্য বেরিয়ে এল। কর্মকর্তারা বলছেন, শীঘ্রই রাজধানীতে এক কর্মশালার মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্বল ও অকার্যকর বিদ্যালয়ে ঠিকমতো পাঠদান হয় না। শিক্ষার পরিবেশও ভাল নেই, পরীক্ষার ফলও ভাল হয় না। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরনের মূল্যায়ন হয়। কিন্তু ওই সব দেশের বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকরা অনেক দায়িত্বশীল। তারা তথ্য গোপন করেন না। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও আশা করতে পারব না যে প্রধান শিক্ষকরা তথ্য গোপন করবেন না। এটা এখনও দুরাশা। তাই বাস্তব চিত্র আরও খারাপ হতে পারে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরাই। তারা বলছেন, যেহেতু এটা স্বমূল্যায়ন একটি রিপোর্ট, যেখানে শিক্ষকরাই তথ্য দিয়েছে। তাই প্রত্যেকেই হয়তো বাস্তব অবস্থা থেকে ইতিবাচক তথ্য দিয়েছেন। কারণ প্রত্যেকেই চেয়েছেন তাদের অবস্থান খারাপ বলে প্রকাশ না হোক। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত হয় এ স্ব-মূল্যায়ন জরিপ প্রতিবেদন। প্রতিবেদন বলছে, পাহাড়ী, হাওড়, উপকূলীয় এলাকা ছাড়াও নদীমাতৃক এলাকা এবং সমতল এলাকায় প্রায় ১০ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠান আছে চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে খুব ভাল মানের ‘এ’ ক্যাটাগরির মাধ্যমিক স্কুল এক হাজার ৬১৮টি। এরপর মোটামুটি ভাল ‘বি’ ক্যাটাগরির স্কুল ৯ হাজার ৩৬৭টি। মধ্যম সারির ‘সি’ ক্যাটাগরির স্কুল ৬ হাজার ৩৪৪টি। আর দুর্বল ‘ডি’ ক্যাটাগরির স্কুল এক হাজার ৫৮টি, একেবারে অকার্যকর ‘ই’ ক্যাটাগরির স্কুল আছে ২৮টি। দেখা যাচ্ছে, সবচাইতে বেশি ‘বি’ ক্যাটাগরির স্কুল নয় হাজার ৩৬৭টি। সারাদেশের মোট আঠারো হাজার ৪১৫টি স্কুল মূল্যায়নের আওতায় এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্বল ও বিদ্যালয়ে ঠিকমতো পাঠদান হয় না। শিক্ষার পরিবেশও ভাল নেই, পরীক্ষার ফলও ভাল হয় না। মোট সাত সূচক ও ৪৫টি সহ-সূচকের ভিত্তিতে এই মূল্যায়ন জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সাত সূচক হলো-শিখন ও শেখানোর পরিবেশ, প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্ব, শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব, শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব, সুপেয় পানি এবং টয়লেটের ব্যবস্থা ও সহ-শিক্ষাক্রমিক কর্মসূচী এবং সহশিক্ষা কার্যক্রম। এই সূচকগুলো কেমন অবস্থায় আছে, তা প্রধান শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সকল যোগ্যতা বিচারে ৯০ শতাংশের উপর যারা নম্বর পেয়েছে তা ‘এ’ ক্যাটাগরি, ৮০ থেকে ৮৯.৯ শতাংশ নম্বর পেলে ‘বি’ ক্যাটাগরি, ৭০ থেকে ৭৯.৯ শতাংশ নম্বর পেলে ‘সি’ ক্যাটাগরি, ৫০ থেকে ৬৯.৯ শতাংশ নম্বর পেলে ‘ডি’ ক্যাটাগরি এবং ৪৯.৯ শতাংশ নম্বর পাওয়া স্কুলগুলোকে রাখা হয়েছে ‘ই’ ক্যাটাগরিতে। এর ভিত্তিতেই বিদ্যালয়গুলোকে ‘এ’ (অতি উত্তম), ‘বি’ (ভাল), ‘সি’ (মধ্যম), ‘ডি’ (দুর্বল) ও ‘ই’ (অকার্যকর) এই পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রধান শিক্ষকদের এমন মূল্যায়নের জন্যই এ প্রতিবেদনের নাম ‘স্ব-মূল্যায়ন’। নির্ধারিত ফরমে তথ্যছক পূরণ করে দেন প্রধান শিক্ষকরা। প্রাথমিক যাচাই করেন উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসাররা। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ও সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচী বা সেসিপের একটি প্যানেল যৌথভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে সারাংশ তৈরি করে। কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ‘ডি’ ও ‘ই’ ক্যাটাগরির স্কুলগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়, ভাল এবং খারাপ পারফর্মিং স্কুলগুলোর মধ্যে একাডেমিক এক্সচেঞ্জ ভিজিটের ব্যবস্থা করতে হবে। নায়েম, এনসিটিবি ও মাউশি অধিদফতরের মধ্যে যথাযথ কোঅর্ডিনেশন থাকতে হবে। মাঠপর্যায়ের সুপারিভশন ও মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিকল্পনা শাখার উপ-পরিচালক খুরশীদ আলম প্রতিবেদন তৈরির মূল কাজ করেছেন। মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যায়নের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলো আত্মবিশ্লেষণ করতে পারে। এর ভিত্তিতে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত হয় এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া যায়। স্ব-মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করতে দেশের সকল মাধ্যমিক স্কুলকে বাধ্য করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে সব স্কুলেই একটি ফরম পাঠানো হয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ফরমে তথ্য পাঠান। এরপর উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসে যাচাই শেষে তা অধিদফতরে আসে। এরপর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ প্রতিবেদন তৈরি করে। এদিকে গত দুই বছরের প্রতিবেদন বলছে, দেশে ভাল মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব থাকলেও সে অভাব পূরণ হচ্ছে কমই। দুই বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই বছরের ভাল প্রতিষ্ঠান বাড়লেও তা চোখে পড়ার মতো নয়। শতাংশ হারে তা ১ থেকে ২ শতাশের বেশি বাড়েনি। জানা গেছে, এক বছর আগের প্রতিবেদন অনুসারে দেশে ‘খুব ভাল’ মানের স্কুলের সংখ্যা ছিল আট শতাংশের মতো। পাহাড়ী এলাকার প্রায় আট শতাংশ স্কুল ছিল চ্যালেঞ্জের মুখে, হাওড় এলাকার ছয়, উপকূলীয় এলাকার ছয়, নদীমাতৃক এলাকার নয় এবং সমতল এলাকায় চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল ৯ শতাংশ স্কুল। ‘এ’ ক্যাটাগরির স্কুলের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩৪৫, ‘বি’ ক্যাটাগরিতে নয় হাজার ১৬৭, ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ছয় হাজার ৩৭৮, ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে এক হাজার ৪৪০ ও ‘ই’ ক্যাটাগরিতে ছিল ৫৫ স্কুল। গত দুই বছরই এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন মাউশির পরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলছিলেন, মূল্যায়নের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলো আত্মবিশ্লেষণ করতে পারে। এর ভিত্তিতে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত হয় এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া যায়। তিনি বলেন, আমাদের এ রিপোর্ট আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। যে কোন বিচারে এ রিপোর্ট মানসম্পন্ন। ইতোমধ্যেই এর প্রমাণও আমরা পেয়েছি। আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদনেও আমাদের রিপোর্টের ফলাফলের সঙ্গে মিলেছে। এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক একই সঙ্গে বলেন, আমরা আগের তুলনায় ভাল করছি। ভাল মানের স্কুল বাড়ছে। সে সংখ্যা কম হলেও বাড়ছে। তবে একথা ঠিক এই ভালতে হবে না। আমাদের আরও ভাল করতে হবে। কারণ দেশে ভাল মানের প্রতিষ্ঠানের অনেক অভাব আছে। এদিকে শিক্ষাবিদরাও বলছেন ভাল মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবের কথা। তবে গত কয়েক বছরের ভাল প্রতিষ্ঠান বেড়েছে বলেও বলছেন তারা। জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, একজন শিক্ষার্থীর জীবনের দিকনির্দেশক কম্পাসের ভূমিকা পালন করে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সে কারণে মানসম্মত শিক্ষার জন্য উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ দেশে ভাল মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে।
×