ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফজলুল হক খান

অভিমত ॥ বাংলা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হওয়া উচিত

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ বাংলা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হওয়া উচিত

বিশ্বের জাতিসমূহের সংগঠনের নাম জাতিসংঘ-যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পারিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত লীগ অব নেশনস, ১৯৪৫ সালে ৫১টি রাষ্ট্র কর্তৃক জাতিসংঘের সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে পরিবর্তিত রূপ নেয় বর্তমান জাতিসংঘ। ২০১৬ সালের তথ্যানুসারে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা ১৯৩। বিশ্বের প্রায় সব স্বীকৃত রাষ্ট্রই এর সদস্য। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হলো তাইওয়ান ও ভ্যাটিকান সিটি। অন্যান্য কিছু অস্বীকৃত এলাকার মধ্যে রয়েছে ট্রান্সনিষ্ট্রিয়া ও উত্তর সাইপ্রাসের তুর্কী প্রজাতন্ত্র। সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র হলো দক্ষিণ সুদান। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে ১৭.০৯.১৯৭৪ সালে। জাতিসংঘের সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো হলো সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশীপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। এছাড়াও রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ইত্যাদি। জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী হলেন মহাসচিব। জাতিসংঘের সদর দফতর নিউইয়র্কে হলেও এর বেশ কিছু অঙ্গ সংগঠনের প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, কানাডার মন্টিল, ডেনমার্কের কোপেনহ্যাগেন, জার্মানির বন ও অন্যত্র অবস্থিত। জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হলো ৬টি। এগুলো হলো ইংরেজী, ফরাসি, চীনা, আরবী, রুশ এবং স্প্যানিশ ভাষা। জাতিসংঘের সচিবালয়ে যে দুটি ভাষা ব্যবহৃত হয় তা হলো ইংরেজী ও ফরাসী। জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষাগুলোর মধ্যে ইংরেজী ৫২টি সদস্য দেশের সরকারী ভাষা, ২৯টি সদস্য দেশের সরকারী ভাষা হলো ফরাসী, আরবী ২৪ টি, স্প্যানিশ ২০ টি, রুশ ৪ টি এবং চীনা ভাষা ২ টি দেশের সরকারী ভাষা। জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে বাংলা ভাষাভাষিরা পৃথিবীর মধ্যে ৮ম স্থানের অধিকারী। সেটি বড় কথা নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভান্ডার পৃথিবীর অনেক ভাষা থেকেই প্রাচীনতম এবং সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হলো চর্যাপদ। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলাভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী। মধ্যযুগকে যদিও বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয় তথাপি এ সময়ের সাহিত্য নিদর্শন কম নয়। প্রাকৃত ভাষায় গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ প্রাকৃত পৈঙ্গল, রামাই পন্ডিত রচিত শূন্য পুরান, চন্ডীদাসের বৈষ্ণবপদাবলী, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, হলায়েধ মিশ্র রচিত সেক শুভোদয়া। এছাড়াও রয়েছে ডাক ও খনার বচন ইত্যাদি। এগুলো চর্যাপদের পরে বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রাচীনতম কাজ বলে বিবেচিত হয়। সে যুগেও গীতি কবিতা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে মানবতার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ চন্ডীদাসের এই উক্তি যুগ যুগ ধরে অমীয় বাণী হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্থান দখল করে আছে। মূলত: বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রিঃ পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মত প্রকাশ করেছেন। কালের দিক থেকে আধুনিক যুগকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়। ১৭৬০ থেকে ১৭৯৯ আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব, ১৮০০ থেকে ১৮৫৮ দ্বিতীয় পর্ব, ১৮৫৯-১৯০০ তৃতীয়পর্ব, ১৯০১-১৯৪৭ চতুর্থপর্ব, ১৯৪৮-২০০০ পঞ্চমপর্ব, ২০০১ থেকে বর্তমান অর্থাৎ ষষ্ঠ পর্বের সূচনা। আধুনিক যুগের সব পর্বেই, বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় যেমন সাহিত্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোট্টগল্প, বাউল সাহিত্য, লোকসাহিত্য, কবিতা, গান, নাটকের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। বাংলা সাহিত্যে এই অভাবনীয় উন্নতির পিছনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, প্যারিচাদ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দোপধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, সুকুমার রায়, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখের অবদান উল্লেখযোগ্য। শুধু তাই নয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা সাহিত্যে নোবেল অর্জন বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসী’-এমন অর্থবহ, কাব্যিক ছন্দময়, হৃদয়গ্রাহী, মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, শ্রুতিমধুর জাতীয় সঙ্গীত পৃথিবীর আর কোন ভাষায় রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক রচিত আমাদের রণসঙ্গীত ‘চল্ চল্ চল্ ,উর্ধ গগনে বাজে মাদল’ এমন সুন্দর উদ্দীপনাময় তাল-লয় সুর ও ছন্দে সমৃদ্ধ রণসঙ্গীত পৃথিবীর আর কেউ রচনা করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। এগুলো বাংলা সাহিত্যের তথ্য ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দান করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষার রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস। পৃথিবীর কোন জাতি মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়নি, জীবন দেয়নি। অথচ আমাদের মাতৃভাষা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্ত দিয়ে কেনা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে তাঁরা শহীদ হন। সেদিন থেকেই দিনটি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এবং আলতাফ মাহমুদের সুরে একুশের মর্মস্পর্শী কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে এবং বাংলা ভাষা, বাঙালী জাতি যতদিন পৃথিবীর বুকে থাকবে ততদিন এ কালজয়ী গান অমর হয়ে থাকবে। লেখক : গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
×