ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মামলার জট খুলবে কবে

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

মামলার জট খুলবে কবে

আদালতগুলোতে বাড়ছে মালার জট। মামলার ভারের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বিচার কাজ। এ যেন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ এই ক্রন্দনধ্বনি ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ সম্ভবত শুনতে পায় না। বিচার প্রার্থীরা আজও হচ্ছেন ভোগান্তি এবং হয়রানির শিকার। মামলার জালে আবদ্ধ মানুষ কবে এই বিড়ম্বনা থেকে পাবেন মুক্তি, জানা নেই বুঝি কারও। পুরনো মামলার জট সহজেই ছাড়ছে না। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রতিমাসে হাজার হাজার মামলা। আর বাড়ছে আসামির সংখ্যা। একেকটি মামলা নিষ্পত্তি হতে লাগছে দীর্ঘ সময়। এমনকি অনেক মামলা দুই যুগেও করা যাচ্ছে না নিষ্পত্তি। দীর্ঘদিনেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলার বাদী-বিবাদীর মাঝে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক শত্রুতা। এরই জের ধরে ঘটছে নানা অপরাধ, খুন-খারাবি পর্যন্ত। মামলার আসামি হয়ে আদালতে হাজিরা দিতে দিতে হয়রান হলেও মামলা নিষ্পত্তি আর হয় না। আদালত প্রাঙ্গণে গেলে দেখা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলের শত শত বিচারপ্রার্থী আদালতে ভিড় করছেন। মামলা জটের কারণে অনেকে পরবর্তী তারিখ জেনে বাড়ি ফিরছেন। আবার অনেকে নতুন মামলা করার জন্য আইনজীবীদের পরামর্শ নিচ্ছেন। এরা মামলার আসামি হয়ে আদালতে হাজিরা দিতে দিতে হয়রান। একবার হাজিরা দিতে এলে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা হয় খরচ। অনেকের পক্ষে গ্রাম থেকে সকালে সঠিক সময়ে আদালতে পৌঁছানও সম্ভব হয় না। তাই আগের দিন জেলা শহরে চলে আসতে হয়। হোটেলে থাকা-খাওয়া এবং পরিবহন খরচসহ চলে যায় দুই হাজারের বেশি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এই আসা-যাওয়া চলে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির কোন লক্ষণ দেখা যায় না। অধস্তন আদালত এবং তার বিচারকরাও মামলার ভারে জর্জরিত। তাদের অনেক কম লোকবলের সহায়তায় বেশি কাজ করতে হয়। দেখা গেছে, গ্রামীণ জনপদে সংগঠিত ছোটখাটো সমস্যাগুলো সরাসরি আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ যদি এই বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে, তাহলেই আদালতে মামলা জট কমে আসার সম্ভাবনা থাকে। জমি নিয়ে বিরোধ, নারী নির্যাতন ও মাদকদ্রব্য নিয়ে বেশি মামলা হয়, অথচ সেই হারে বিচারক নেই। ফলে মামলা জট হচ্ছে। মামলা নিরসনে বিচারক ও আদালতের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। এক হিসাবে দেখা গেছে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপীল বিভাগসহ সব ধরনের আদালতে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা একত্রিশ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮। চলতি বছর শেষ হলে দেখা যাবে এর সঙ্গে আরও প্রায় দশভাগ মামলা যুক্ত হয়েছে। মোট মামলা দায়ের থেকে মোট মামলা নিষ্পত্তির হার কমেই চলছে। ২০২০ সাল নাগাদ মামলার জট পঞ্চাশ লাখে দাঁড়াতে পারে। সমস্যার অন্যতম কারণ আদালতে সময়। জেলা শহরে বেলা এগারোটার আগে আদালত কাজ শুরু করে না। বাদীসহ সংশ্লিষ্টদের পথের দূরত্বের কারণে এই অবস্থা। এর সঙ্গে রয়েছে মামলার শুনানি মুলতবিকরণের ক্রমাগত তৎপরতা। দিনের পর দিন শুনানি হয় না অনেক মামলার। অধস্তন আদালত সম্পর্কে ১৯৮৯ সালে প্রধান বিচারপতির করা কমিটি উল্লেখ করেছিল যে, বিচারকগণ একতরফা মামলাগুলো নির্দিষ্ট দিনে শুনানি না করে কোন কারণ ছাড়াই অথবা কোর্ট ‘অন্য কাজে ব্যস্ত’ এরূপ আদেশ লিখে দিনের পর দিন ফেলে রাখে। এমন চিত্র তো দেখা যায় প্রায়শই যে, বাদী একতরফা শুনানির তারিখে দিনের পর দিন এমনকি বছর ধরে সাক্ষীসহ উপস্থিত হন। কিন্তু কোর্টের ওই মামলার শুনানি হয় না। কখনও বা একতরফা মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ করা হলেও আদেশের জন্য তা মাসের পর মাস, এমনকি বছর ধরে পড়ে থাকে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা জোরদারে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিচারপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, বিচার বিভাগ বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত ও মামলা জট মোকাবেলা করছে। ‘জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ২০১৭-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে এমনটাও বলেছেন, মোকদ্দমার যুক্তিতর্ক শুনানির পর যখন রায় প্রকাশে বিলম্ব হয়, তখন সে বিলম্বের একক দায় সংশ্লিষ্ট বিচারককেই নিতে হবে। সঠিক বক্তব্যই তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপতি। এটা তো বাস্তব, বিচারে কাক্সিক্ষত গতি আনার জন্য পর্যাপ্ত বিচারকক্ষ, বিচারকদের শূন্যপদে নিয়োগ এবং বিচারক ও মোকদ্দমার সংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক। দেশে আইনের শাসনকে পাকাপোক্ত করার জন্য প্রয়োজন মামলার জট নিরসন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার। না হলে জনগণের ভোগান্তি ক্রমশ বাড়বে।
×