ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ দূতাবাসগুলোর বোধোদয় হবে কি?

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ দূতাবাসগুলোর বোধোদয় হবে কি?

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সবসময় স্পষ্টভাষী। তাঁর এই গুণের জন্য তিনি আমাদের মতো মানুষের কাছে বন্দিত। রাখ ঢাক করে কথা বলার মানুষ নন তিনি। খবরে দেখলাম রাষ্ট্রদূতদের এক সম্মেলনে তিনি বিদেশে ষড়যন্ত্র আর অপতৎপরতা বিষয়ে দূতদের সাবধান করে দিয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা বিষয়ে বিদেশে দূতাবাসের কার্যক্রম আর ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। এ ধরনের মতবিনিময় সভা আরও আগে হলেই ভাল হতো। আমরা যারা প্রবাসী দেশের বাইরে বসবাস করি আমাদের কাছে এত বছর পরও দূতাবাস কৌতূহল ভয় আর আবেগ মেশানো এক জটিল বিষয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা কি হওয়া উচিত বা তাঁরা কি কি কাজ করতে পারেন সেটা তাঁরা যেমন জানেন, আমরাও বুঝি। কিন্তু তারপরও জটিলতা যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এবং তারপর জাতির পিতার খুনীদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে যেমন বলেছেন তেমনি সাবধান করে দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর এসব বিষয়ে জেগে ওঠা কুবিতর্ক নিয়ে। আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল জটিল বৈশ্বিক রাজনীতিতে আমাদের ভূমিকা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সবার আগে বলতে হবে দুনিয়া এখন বদলে গেছে। যে আমেরিকা একাত্তরে পাকিস্তানের পেয়ারা দোস্ত ছিল সে আমেরিকা এখন পাকিদের ভাল চোখে দেখে না। প্রশাসনের দেখা না দেখার পেছনে রাজনীতি আর স্বার্থই থাকে কার্যকর। এ জন্যই আজকের পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার তেমন কোন গভীর মনোযোগ নেই। তার মনোযোগ ভারতের দিকে বেশি। কারণ, ভারত আর্থিক দিকে সামাজিক বাস্তবতায় অনেক এগিয়ে। ঠিক একইভাবে আমাদের উন্নয়ন আর প্রগতি যতটা ততটাই আমেরিকা ইউরোপকে কাছে টেনেছে। এখানে মায়া বা ভালবাসার কোন জায়গা নেই। ইতিহাস আর শুদ্ধতা যদি বিচারক হতো জন কেরি শেখ হাসিনাকে ফোন করে কারও শাস্তি মওকুফের জন্য আবেদন করতেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন লড়াই করেন প্রজ্ঞা দিয়ে। দেশের চাইতেও বাস্তবে বিদেশে তাঁর জনপ্রিয়তা অধিক। মূর্খরা মনে করে এর পেছনে আছে নাকি স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া। এটা ভুল ধারণা। তিনি বাংলাদেশকে সম্মানের জায়গায় উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন বলেই তাঁকে এভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে। আমাদের দূতাবাসে বা দূতাবাসগুলোতে যাঁরা চাকরি করেন বা যাঁরা পোস্টিং পান তাঁদের একটা ধারণা থাকে তাঁরা বাঙালীদের অভিভাবক। এই ধারণা মিথ্যাও না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তাঁরা সেসব দেশের মূলস্রোত বা সেসব দেশের রাজনীতি ও কর্তাদের চাইতে অধিক সময় ব্যয় করেন নিজ দেশের মানুষের অনুষ্ঠানে। জাতীয় দিবস কিংবা বিশেষ বিশেষ দিনে তা হতেই পারে। আমি যতটুকু দেখেছি তাতে একথা বলতে পারি এদের অনেকেই বিদেশে আসাটাই উপভোগ করেন বেশি। মজার ব্যাপার প্রধানমন্ত্রী সেটাও বোঝেন। আর জানেন বলেই ‘কূটনীতিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের প্রবাসী বাঙালী যারা আছেন, যেন কোনভাবে হয়রানির শিকার না হন। তাদের দিকে মানবিক দৃষ্টি দিয়ে আচার-আচরণ করবেন। তাদের একটা আস্থার জায়গায় এনে দেবেন। প্রবাসীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতিতে তারা বিরাট অবদান রাখছেন। আমরা এতগুলো কূটনীতিক মিশন চালাচ্ছি। এর সিংহভাগ উপার্জন কিন্তু তারা করছেন।’ এমন করে আর কেউ কোনদিন বলেছেন কি-না জানি না। মনে পড়ছে প্রথমবার সেই ১৯৯৯ সালে তিনি যখন সিডনি এসেছিলেন তাঁর সম্মানে আয়োজিত সভায় স্থানীয় প্রবাসীদের কয়েকজন সরাসরি নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন সেসব কর্মকর্তার কিভাবে হয়রানি করেন। এই বিদেশেও মাছ মসলা বা উপঢৌকনের জন্য তাদের লালসার কথা জেনে প্রধানমন্ত্রী কিছু জরুরী পরিবর্তনও করে দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন সে বাস্তবতা বহুলাংশে বিলীন। কিন্তু তার মানে এই না যে, একেবারে নেই। বছরখানেক আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে সদ্য বিদায়ী এক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে হাজির প্রবাসী বাঙালীদের কেউ কেউ নাম ধরে অভিযোগ জানিয়ে বলেছিলেন, তাদের ফোনের জবাব দেয়া হয় না। অনেক সময় ফোন নাকি রিসিভও করা হয় না। আরও কিছু হয়রানির কথা তারা সেদিন স্পষ্ট করে জানালেও এর কি বিহিত করা হয়েছিল সেটা আর জানা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী যে বললেন প্রবাসীদের উপার্জনের টাকাতেই মূলত দূতাবাস চলে এটাই আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই বলেই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। আমার একুশ বছরের প্রবাসী জীবনে আমি কর্মনিষ্ঠ একাগ্র রাজদূত যেমন দেখেছি তেমনি কথায় পটু আর বাঙালী সমাজের ভালমন্দ নিয়ে দিনাতিপাত করা রাষ্ট্রদূতও দেখেছি। ধারণা করি এর পেছনে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষও আছেন বৈকি। এরা সরকারী দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কিংবা নিজেদের ব্যক্তি ও সামাজিক ইমেজের নামে প্রভাব বিস্তার করেন। অথচ কে না জানে আজ যেভাবে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয় যদি আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকে তা হবে না। এবং আদৌ তার কোন চিহ্ন থাকবে কি-না সেটা বলাও মুশকিল। এই জায়গাটা বা এ ধরনের বিষয়গুলোর স্থায়ী মীমাংসা জরুরী। ভারত পাকিস্তানের দূতাবাসে যেমন গান্ধী বা জিন্নাহকে নিয়ে বিতর্ক নেই তেমনি আমাদের দূতাবাসেও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে যাবতীয় ধোঁয়াশার শেষ হতে হবে। যে আসবে যে যাবে যে সরকার থাকবে সবাইকে মানতে হবে জাতির জনক জাতির জনকই। এ নিয়ে কোন তর্ক বা বিবাদ চলবে না। এটা কোন রাজদূতের দ্বারা হবার নয়। এর জন্য চাই রাজনীতির শুদ্ধতা। তবে যারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে আছেন তাঁদের রহস্যময় ভূমিকা আমরা আর দেখতে চাই না। এই রহস্যময় ভূমিকার মূল কারণ পদ আঁকড়ে থাকা। দুনিয়ার সব দেশে আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক ও বিশ্বাসী মানুষ আছেন, থাকবেনও। কিন্তু জাতীয় ইস্যুতে আমাদের বিরোধ যেন দেশের বিরুদ্ধে চলে না যায়। গণজাগরণ মঞ্চে এবং তার পরে বিচার ও শাস্তির সময় সারা দুনিয়ায় এক ধরনের অস্থিরতা আর অসহনীয় পরিবেশ বিরাজ করেছিল নানামুখী ষড়যন্ত্র নানা ধরনের গুজব দেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল। তখন কোন দূতাবাস কি করেছিল সেটা জানার অধিকার মানুষের আছে বৈকি। এখানে দেখেছি বিষয়টা আমাদের না, এমন এক মনোভাবে নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা। কেউ তাদের বলেনি রাজনীতি করতে। কেউ বলেনি কারও দলে নাম লেখাতে। শুধু দেশ আর দেশের ভাবমূর্তি বাঁচানোর কাজ করাটাই ছিল প্রত্যাশা। তাঁরা তা করেননি। আর করলেও আমাদের জানা নেই। যার মানে বিষয়টা প্রকাশ্য করাটাকেই তারা ভয়ের ব্যাপার মনে করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও সাধারণ বাঙালীদের ভেতর আশ্রয় দেয়া না দেয়া দেশের পরিবেশ ও রাজনীতি নিয়ে দু ধরনের মত আছে। তারপরও সবাই চায় এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক। মানুষ এখানে সাহায্য তুলেছে। টাকা পাঠিয়েছে। সামনের সপ্তায় একটি মধ্যাহ্ন ভোজনের অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ যাবে তাদের কল্যাণে। এগুলো ব্যক্তি বা সামাজিক উদ্যোগ। আমরা জানি না আমাদের দূতাবাস অস্ট্রেলিয়াকে আমাদের ভূমিকা আমাদের মানবিকতা এবং নাজুকতা কতটা বোঝাতে পেরেছেন। আদৌ তারা তা চান কি-না সেটাও আমরা জানি না। অথচ জানার অধিকার আছে মানুষের। একাত্তরে বা নানা দুঃসময়ে বিদেশের দূতাবাসগুলো সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূলিকা রেখেছিল। সে কাহিনী এখন ইতিহাস। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে বলেছেন পঁচাত্তরের ঘাতকেরা বিদেশের দূতাবাসে পোস্টিং পেয়ে দেশ ছেড়েছিল তাদের প্রেতাত্মাই হয়তো এখন আর তেমন কাজ করতে দেয় না। সঙ্গে আছে দেশের পচে যাওয়া রাজনীতি। দলভিত্তিক বিভেদ। এই সম্মেলনের পর রাজদূতেরা নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই নড়ে চড়ে বসবেন। এখনও সময় আছে আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা সমস্যাসহ দেশের প্রগতি আর উন্নয়নের কথা তুলে ধরার। এতে তাঁরাও লাভবান হবেন। আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি প্রবাসীরা তাদের সম্মান করেন ভালবাসেন। কিন্তু প্রভুত্ব পছন্দ করেন না। দূতাবাসের বেশিরভাগ কর্মীই মনে করেন তারা আলাদা। বিশেষ শ্রেণীর কেউ। এই ধারণা ঔপনিবেশিক। এ থেকে বেরুতে হবে। যতদূর বুঝি আমাদের অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন এখনও অনেক স্বচ্ছ আর জাবাবদিহিতার ভেতরেই আছে। সামনের দিনগুলোতে তাদের কর্মদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আরও বেগবান হোক। মূলত দেশের স্বার্থে প্রগতির স্বার্থে ইমেজের স্বার্থে তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালনের কোন বিকল্প নেই।
×