ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

গত বছরের বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

গত বছরের বাংলাদেশের অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতি খ্রিস্টীয় বছর হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ঘোষণা করা হয়েছিল মাথাপিছু আয় হচ্ছে মার্কিন ডলার ১৪৬৬। আর চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৭.১১% এর মতো। বাজেটে অর্থের পরিমাণ যেমন বেড়েছে। ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক মানদ-ে মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস পেয়েছে। এদিকে ঢাকা শহরে দৈনিক গড়ে ১৫০০ লোক কর্মসংস্থানের জন্য এসে থাকেন, যদিও ভাসমান লোক আসেন আরও বেশি মাত্রায়। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ শ্রেণী এবং নিম্ন শ্রেণীতে বেশি। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধের অভাব ঘটছে; শ্রদ্ধা, ভালবাসা, নিরাপত্তা কমে যাচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে নিম্নবিত্তের একজন বস্তিবাসী যে পরিমাণ আয় ও ভোগ করছে সমপর্যায়ের ব্যক্তি গ্রামীণ এলাকায় আয়-ভোগ কম করলেও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও খাদ্য গ্রহণে অপেক্ষাকৃত ভাল আছে। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় উত্থান-পতনের যুগে গ্রামীণ এলাকার মানুষ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি সচ্ছল ও কর্মসংস্থানের সম্মুখীন হচ্ছে। তবে আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, শ্রেণীচরিত্রের পরিবর্তন ঘটছে। আগে যারা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা ধীরে ধীরে সরে আসছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। অথচ উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরির জন্য সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। ধোলাইখাল এলাকায় শিল্প বেল্ট গড়ে তোলা গেলে বেসরকারী উদ্যোক্তারা আরও সৃষ্টিশীলতা ও নৈপুণ্য দেখাতে পারত। পূর্বতন বছরে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ শিল্প এলাকা তৈরির প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আসলে আমাদের দেশের জন্য কতটুকু সাশ্রয়ী হবে নাকি ঝঃধঃব রিঃযরহ ঃযব ংঃধঃব হিসেবে কাজ করবে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। সরকার বিদায়ী বছরে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার বিভেদ সংকোচনে সচেষ্ট ছিল। অথচ কোন কোন স্থানে এ বিভেদকে উস্কে দিয়েছে ঘাপটি মারা কিছু গিরগিটি; যারা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। এদিকে সরকার গত বছরে দুই ঈদে দীর্ঘ ছুটি দেয়ার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যারা গ্রামীণ এলাকায় গেছেন তারা সেখানে খরচ করায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে মুদ্রার সম্প্রসারণ ঘটেছে। মুদ্রার হাত বদল হতে হতে এক সময় অর্থ বণ্টন ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও কাজ সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে পর্যটন ব্যবস্থাতেও সরকার বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছেন। তবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে যে ধরনের কর্ম উদ্দীপনা এবং হোলিস্টিক এ্যাপ্রোচ দরকার তার অভাব রয়েছে। কেননা পর্যটন শিল্প কেবল আনন্দ ভ্রমণ নয়। বরং চিকিৎসা, স্বাস্থ্য শিক্ষাখাতের পাশাপাশি ধর্মীয়, ব্যবসা-বাণিজ্যিক কারণে ঘটে থাকে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে পর্যটককে বিদেশ থেকে আসতে হলে যে ধরনের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার তা নেই। তারপর কিছু কিছু বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে যা এত ব্যয়বহুল যে, বলা চলে এক একটা কসাইখানা। সরকারী হাসপাতালের সিংহভাগ ডাক্তারই বেসরকারী হাসপাতালে ছুটে বেড়ান। এদিকে ডাক্তার-নার্সের অনুপাত মোটেই সঠিক নেই। পাশাপাশি বহু নার্সই রোগীদের উপযুক্ত পরিচর্যা করেন না। প্রাইমারী থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দড়ি টানাটানিতে প্রাথমিক শিক্ষার অধিকাংশ বই-ই ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স অনুপাতে বইয়ের মান অনেক উচ্চ হয়েছে; যা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুপযুক্ত বইগুলোকে যথোপযুক্ত করতে পারে। শিক্ষা এখন একটি ব্যবসা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আগের মতো কেবল জ্ঞানের জন্য পড়াশোনা না হয়ে পাঠ ও পঠনের জন্য শিক্ষা হচ্ছে। অথচ এ শিক্ষার কোন মার্কেট ভ্যালু নেই। সুযোগ বুঝে শিক্ষাক্ষেত্রে একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী, কিছু অসাধু শিক্ষক নামধারীর যোগাসাজশের কারণে সরকার প্রধানের ইচ্ছা অনিচ্ছায় রূপান্তরিত হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন সরকার প্রসারের পাশাপাশি গুণগতমান বাড়াতে চেষ্টা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। শিক্ষা ক্ষেত্রে মান উন্নয়নের পদক্ষেপ হিসেবে এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠনের প্রয়োজন। পাশাপাশি র‌্যাংকিং ব্যবস্থাও চালু করতে হবে। গবেষণা ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশী ইনডেক্সিং যাতে ইউজিসি প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। আসলে সরকারী পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার প্রবর্তন করা দরকার। জঙ্গী হামলা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তারপরও এ সরকারের দৃঢ় ভূমিকা তথা জিরো টলারেন্স নীতির কারণে জঙ্গী সমস্যা তেমন ছিল না। বিগত সময়ে হলি আর্টিজানে পৈশাচিক হামলা এবং শোলাকিয়ায় ঈদগাহ ময়দানে হামলার প্রয়াস মনে করিয়ে দেয় আমরা বুঝি ভূতের পাঁচ পায়ের মতো পেছনের দিকে যাত্রা করছি। সরকার দেশের কাঠামোগত সংস্কারের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু ঐ হলি আর্টিজান হামলার পর মেট্রো রেল প্রজেক্টের কাজ তেমন এগুচ্ছে না। এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, মেট্রো রেলের জন্য বরাদ্দকৃত খাত থেকে ২০০ কোটি টাকার মতো অর্থ ভিন্নখাতে যাচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল ঐ অঘটন ঘটার পর পরই থাইল্যান্ডে যোগাযোগ না করে বিশেষজ্ঞ আনয়নের ব্যবস্থা করা। আসলে দেখা যায়, সরকার প্রধান যেদিকে নজর দিতে না বলবে সেদিকে পারিষদরা সচরাচর নজর দিতে চান না। এদিকে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেসরকারী উদ্যোগে জমির ব্যবসা গড়ে উঠছে, কল-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে যা মোটেই দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। একটি দেশে ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের প্রয়োজন আছে। বৃক্ষহীন হয়ে পড়লে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট সরকারী ও বেসরকারীখাতে বিনিয়োগের যে বিশাল টোপ ফেলেছেন তা আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য সত্যিকার অর্থে বিচার-বিবেচনা করেই তবে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এদিকে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় ৪৪তম বড় বাজার তালিকায় এমিনাল হিসাব অনুসারে রয়েছে। ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২তম। যে সমস্ত দেশ আগামীতে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১১টি রাষ্ট্রের মধ্যে। আইএমএফের মতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত ধাবমান অর্থনীতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং প্রবৃদ্ধির পরিমাণ হচ্ছে ৭.১%। বাংলাদেশ যদিও রফতানিমুখী শিল্পায়নে বিশ্বাসী বাংলাদেশের গড় জিডিপির পরিমাণ হচ্ছে ৬.৫%। এক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি রয়েছে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ এবং কৃষিখাত। বর্তমান পোশাক শিল্পখাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৮২% বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সংযুক্তি ঘটছে। কিন্তু এ বিশাল সংযোজন দেশের জন্য সুফল বয়ে আনলেও সাপোর্টিভ সার্ভিস প্রোভাইড করা গেলে তা দেখা যেত কতটুকু কাজে লাগছে। এদিকে সরকার বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ ইনসেনটিভ দিচ্ছে। আদৌ তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। আবার মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি কিছুটা হলেও তাদের অর্থনীতি পড়তির দিকে। প্রবাস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ আগের থেকে কমে গেছে যদিও অনেক বেশি সংখ্যক লোক বিদেশে গেছে। জিডিপির মাথা পিছু ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১৫০তম। কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত থেকে জিডিপিতে আছে ১৫.৫%, ২৮.১% ৫৬.৩% ক্রমান্বয়ে। সেবাখাত বৃদ্ধির পরিমাণ খুব বেশি যেটি সঙ্কুচিত হওয়া দরকার। মূল্যস্ফীতির হার হচ্ছে ৬.৭%। অন্যদিকে মোট জনসংখ্যার ১৩% যারা দৈনিক মার্কিন ডলার আয় করতে পারে না। দারিদ্র্য ও অসাম্য মাপার জন্য গিনি কফিসিয়েট হচ্ছে ৩২০। দেশের মোট শ্রম সম্পদ হচ্ছে ৮.১৯৫ কোটি। এর মধ্যে ৪০% কৃষিখাতের সঙ্গে জড়িত, শিল্পখাতের ওপর নির্ভরশীল ৩০% এবং সেবাখাতের ওপর নির্ভরশীল ৩০%। দেশে ব্যবসাবাণিজ্য করার সহযোগী পরিবেশ হচ্ছে ১৭৪তম। বাংলাদেশের প্রধান রফতানিকারক বন্ধু রাষ্ট্র হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৩.৯%, জার্মানি, ১২.৯% যুক্তরাজ্য ৮.৯%, ফ্রান্স ৫%, স্পেন ৪.৭%। এক্সপোর্টের পরিমাণ হচ্ছে মার্কিন ডলার ৩৭.৬১ বিলিয়ন (২০১৫-১৬)। অন্যদিকে আমদানির পরিমাণ হচ্ছে ৪০.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০১৪-১৫)। এক্ষেত্রে আমদানি অংশীদাররা হচ্ছে চীন ২২.৪% ভারত ১৪.১%, সিঙ্গাপুর ৫.২% (২০১৫)। মোট বহিঃস্থ ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৩৫.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাবলিক ডেবিটের পরিমাণ হচ্ছে ৩১.৯%। এদিকে বছরের শেষদিকে শেয়ার বাজারে উর্ধমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য পুঁজিবাজারের অন্য দুটো অঙ্গ ফিন্যান্সিয়াল ডেরিবিটিভস ডেবিট মার্কেট গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার এ্যাটাকের ঘটনাটি কেন্দ্র করে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। যে অর্থ পাচার হয়ে গেছে তার সিংহভাগ উদ্ধার করা যায়নি। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়নের প্রয়াস নেয়া দরকার। কেবল ব্লেম গেম করা উচিত নয়। দেশে ব্যাংকিং সেক্টরকে আরও বেশি করে কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরকে অবশ্যই আমলানির্ভর থেকে মুক্ত হতে হবে। বর্তমানে স্থবির হয়ে গেছে সরকারের ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন পদক্ষেপ। দেশে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও এসেছিলেন। তিনিও সহজশর্তে ঋণ দিতে চেয়েছেন। এডিবির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, অর্থবছর ১৫-১৬ তে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যাশার তুলনায় ভাল করেছে। এর কারণ হিসেবে রফতানি অভ্যন্তরীণ ভোগের সহনীয় পর্যায়ে ছিল। মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলনের চেয়ে কমে গেছে, চলতি হিসাব ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত ছিল। চীন ও ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে যে সুসস্পর্ক রয়েছে ট্রাম্প আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কটি উন্নত হওয়া বাঞ্ছনীয়। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়্যাল ইকোনমিস্ট [email protected]
×