ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জুলিয়ান ফ্রান্সিস

প্রতিবন্ধীদের সম্মানে করণীয়

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রতিবন্ধীদের সম্মানে করণীয়

আমার বড় ভাই জেমস, ১৯৪৩ সালে এই পৃথিবীতে এসেছিল কিছু জিনগত শারীরিক সমস্যা নিয়ে। ডাউন সিনড্রোমজনিত কারণে আরও অনেক সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা ছিল জেমসের। আর এসব প্রতিবন্ধকতার মাঝেই ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যের একটি নার্সিং হোমে নিতান্তই অবহেলায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল জেমস্। মারা গেল, কারণ যে ডাক্তাররা জেম্সের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিল তাদের যথেষ্ট সময় বা সদিচ্ছা ছিল না যাতে করে তারা জেম্সের শারীরিক সমস্যার মূলে যেতে পারে। কি হয়েছিল জেম্সের? সামান্য ডায়রিয়া। আর তার জন্য চিকিৎসাও পেয়েছিল জেমস্। কিন্তু ডাউন সিনড্রোমে ভোগা আমার ভাইটা নার্সিং হোমের কাউকে বোঝাতেই পারেনি যে ডায়রিয়ার পাশাপাশি তার আরও সমস্যা ছিল। প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর পুরো বিশ্ব যেখানে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে, আমার ভাই তখন তার কাছের মানুষ নিয়ে পালন করত নিজের জন্মদিন। জেম্সের জন্য, পৃথিবীর সকল শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য, তাদের না বলতে পারা কথাগুলোর জন্য এই দিনটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবনে আমি দেশে বা দেশের বাইরে যখনই কোন রকম প্রতিবন্ধী বিষয়ে কাজ করেছি বা কথা বলেছি, চেষ্টা করেছি মানুষটার দিকে নজর দিতে; চেষ্টা করেছি যেন মানবিক দিকটা তার শারীরিক অবস্থা থেকে উপরে থাকে। আর তাই আমার আশা আমার আজকের এই লেখাটি স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে সুপাঠ্য হবে। আমি আরও আশা করছি এই করণীয় ও বর্জনীয়গুলো আমাদের সাহায্য করবে হাজারও না বলা কথাগুলো বুঝে নিতে। তবে শুরু করার আগে একটি কথা জোর গলায় বলতে চাই, আর তা হলো প্রতিবন্ধী কারও কাছে গিয়ে আপনি যদি বুঝতে না পারেন কি করবেন তাহলে তাকে অকপটে জিজ্ঞেস করুন। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর থেকে কার্যকর কোন উপায় হয় না। তাই প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো এমন হতে পারে কখনোই ভাববেন না যে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ তার সকল রিপু বা শারীরিক অবস্থা থেকেই প্রতিবন্ধী; আমরা না বুঝেই অনেক সময় হুইলচেয়ারে বসা মানুষটার সঙ্গে মেপে কথা বলি, কানে কমশোনা এ রকম কারও সঙ্গে অনাবশ্যক জোরে কথা বলি, বা চোখে দেখে না এমন একজনকে পাশের জনের মাধ্যমে কথা বলি। যা কখনই ওই মানুষটার কাছে কাম্য নয়। প্রতিবন্ধী কাউকে দেখলে জিজ্ঞেস করুন আপনি তাকে সাহায্য করবেন কিনা, আর যদি আপনার দেখে মনে হয় যে ওনার সাহায্য প্রয়োজন তাহলে জানতে চান কিভাবে আপনি সাহায্য করতে পারেন। হয়তো ওই মানুষটি অপরের সাহায্য নিতে লজ্জা পাচ্ছে অথবা সেই মুহূর্তে আপনার সাহায্য তার দরকার নেই। কখনই বলবেন না ‘আপনার জায়গায় হলে আমি এটা চেষ্টাই করতাম না।’ বস্তুতপক্ষে আপনি কখনই জানেন না একজন প্রতিবন্ধী কি করতে পারে আর কি পারে না। কখনই বলবেন না ‘আমি বুঝতে পারি না, আপনি কি করে পারেন? আমি তো মারাই যাব হাঁটতে না পারলে। আপনি ভাবছেন যে আপনি হয়ত তার সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন, বস্তুতপক্ষে আপনার এই কথাটি তাকে ‘অন্যরকম’ ধারণা দিতে পারে। প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে সাধারণ অন্য দশটা শিশুর মতোই আচরণ করুন। অনেক সময় এমন শিশুরা খারাপ আচরণ করে ফেলে। সে সকল ক্ষেত্রে অন্য দশটা শিশুকে আপনি যেভাবে শেখাতেন তাকেও সেভাবে শেখান। নিজের পরিচয় দেখা হবার সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিন। মনে করেন আপনি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে দেখা করে শুধুমাত্র বললেন, ’হ্যালো’। এতে করে তার পক্ষে আপনাকে চিনে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়াটা একটু কঠিন। দেখা হলে বলতে পারেন, ’হ্যালো, আমার নাম তাসনিম। আপনার সঙ্গে গত সপ্তাহে আমার সাহানার বাসায় পরিচয় হয়েছিল।’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কাউকে ডাকার আগে তার নামটি জেনে নিন। এতে করে আপনি ওনাকে ডাকলে উনি চট করে বুঝতে পারবেন যে আপনি ওনাকে ডাকছেন। কখনও ভাববেন না যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কাউকে ‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগল’ বললে সে অস্বস্তি বোধ করবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ব্যাপারটি এমনভাবে ভাবেনই না। হঠাৎ করে কখনও কোন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে স্পর্শ করবেন না। অপেক্ষা করুন, দরকার হলে তিনিই আপনার হাত ধরবেন। আপনার হঠাৎ স্পর্শ তাকে ঘাবড়ে দিতে পারে। আপনি ওনাকে ধরে থাকার চেয়ে উনি আপনাকে ধরলে তা ওনার জন্য বেশি সুবিধাজনক হয়। কখনই বলবেন না, ‘এখানে একটি সিঁড়ি আছে, বলুন একধাপ নিচে বা একধাপ উপরে একটি সিঁড়ি আছে।’ উপরে বা নিচে কোথায় পা ফেলতে হবে তা না জানলে তাদের জন্য ব্যাপারটি কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়া গভীর কোন ধাপ থাকলে তা আলাদাভাবে উল্লেখ করুন। দরজা কখনও অর্ধেক খুলে রাখবেন না, হয় পুরো বন্ধ করুন বা পুরো খোলা রাখুন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলেই যে একজন টেলিভিশন দেখতে পারবেন না, তা ভাববেন না। টিভির কথাগুলো শোনার মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। প্রতিবন্ধী কাউকে সব বাইরের কাজ করে দেবেন না। এতে করে তিনি নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বা নগণ্য মনে করতে পারেন। তাকে বাইরের কাজ যেমন বাজার-সদাই করার ব্যাপারে সাহায্য করুন এবং তিনি করতে চান কিনা তা জানতে চেষ্টা করুন। শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী একজনের কাছ থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নেবেন না। এতে করে তিনি মনে ভয়ানক কষ্ট পান। এক্ষেত্রে সকলের সুন্দর মানবিক আচরণই পারে পরিস্থিতিটাকে সঠিকভাবে সামাল দিতে। শিক্ষণ প্রতিবন্ধী কাউকে ভয় পাবার কোন প্রয়োজন নেই। যদি তিনি মানুষের মাঝে থাকেন তবে তার হঠাৎ হিং¯্র আচরণ করার সম্ভাবনা কম। মনে রাখবেন আপনার একটুখানি অবহেলা এই মানুষটির শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতাকে আরও কষ্টকর করে তুলতে পারে। মনে রাখবেন শুধুমাত্র শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা আছে মানেই যে মানুষটি অনেকের দেয়া কথা বা অঙ্গীকার ভুলে যাবে তা নয়। যেমন আমাদের ছেলে নীল (যার এখন বয়স এখন ৪০)- শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তার স্মৃতিশক্তি ও ধীশক্তি চমৎকার। তাই তাদের কথা দেয়ার সময় চিন্তা করে দিন। মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী একজন কি বলতে চাইছে তা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন। এটা ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই যে, ওনার নিজস্ব কোন মতামত বা চিন্তাধারা নেই। অযথা ও অযাচিতভাবে উপদেশ দেবেন না। পেশাগত কারণে দরকার হলে আপনার মতামত জানাতে পারেন কিন্তু মনে রাখবেন, অযাচিতভাবে উপদেশ কেউই পছন্দ করে না। প্রতিবন্ধী শিশুর পিতা-মাতাকে আলাদা করে কোন অনুকম্পা দেখাবেন না। মনে রাখবেন অন্য সকল পিতা-মাতার মতো তার শিশুও তার কাছে অমূল্য। মনে রাখবেন যে সাহায্যই আপনি করতে চান তা অনেক লম্বা সময় নিয়ে বলতে হবে বা করতে হবে। ধৈর্য হারাবেন না। কখনই একজন মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষকে সামলে চলার কথা বলবেন না। মনে রাখবেন তিনি যদি পারতেন, তবে তিনি তা অবশ্যই করতেন। হুইল চেয়ারে বসা একজনকে অচমকা সরাবেন না। এতে করে তার কষ্ট হয়, সাহায্য হয় না। বরং তাকে জানতে দিন আপনার পরবর্তী দিক কোনটি হবে। হুইল চেয়ার দিয়ে কাউকে কোথাও নিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞেস করুন, যে গতিতে আপনি যাচ্ছেন তা তার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক হচ্ছে কিনা। মনে রাখবেন বেশি গতি বা কম গতি কোনটিই তার জন্য আনন্দদায়ক নয়। হুইল চেয়ারের হাতল ধরে টান দেবেন না। তা হঠাৎ করে খুলে আসতে পারে। আর চেয়ার ঠেলার সময় পেছন থেকে কথা বলার সময় মনে রাখবেন চেয়ারে বসা মানুষটি আশপাশের শব্দের জন্য আপনার কথা বা দিকনির্দেশনা নাও বুঝতে পারেন। তাই কথা বলা বা দিক নির্দেশনা দেয়ার সময় খেয়াল রাখুন। হুইল চেয়ার দিয়ে সিঁড়ি ওঠা-নামানোর ব্যাপারটি আপনার কাছে নতুন হলে চেয়ারে বসা মানুষটিকে জিজ্ঞেস করুন তিনি আপনাকে সব থেকে ভাল সমাধান দিতে পারবেন। শ্রবণপ্রতিবন্ধী কারও সঙ্গে কথা বলার সময় খেয়াল করবেন তিনি যাতে আপনার ঠোঁটের নাড়াচাড়া খেয়াল করতে পারেন। আপনি যদি নড়াচড়া করেন বা আলোর বিপরীতে থাকেন তাহলে আপনার ঠোঁট নড়া দেখে কথা বুঝতে মানুষটির কষ্ট হবে। শ্রবণপ্রতিবন্ধীর কোন কথা না বুঝলে তা তাকে জানান। শুনতে পারেন না বলে যে তিনি বলতেও পারেন না তা নয়। শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের গান শুনতে দিন। তারা শব্দের চলন থেকে শব্দের উচ্চারণ বুঝতে পারে। এবং এই শব্দের চলনটি তারা উপভোগ করেন। লেখক : স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় থেকে বাংলাদেশে দরিদ্রতা দূরীকরণ ও প্রতিবন্ধীবিষয়ক নানা প্রকল্পে কাজ করেছেন
×