ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুর্শিদাবাদ মালদহে সতর্কাবস্থা

আলাতুলির জঙ্গীডেরায় অভিযানের খবরে ভারতেও আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

আলাতুলির জঙ্গীডেরায় অভিযানের খবরে ভারতেও আতঙ্ক

স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ ২৮ নবেম্বর চাঁপাইয়ের পদ্মা নদীর বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরে (মধ্যপাড়া) জঙ্গী ডেরায় অভিযানের খবরে ভারতীয় এলাকায় তোলপাড় পড়ে গেছে। বাংলাদেশের এই জঙ্গী ডেরা থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা অঞ্চল কোয়ার্টার কিলোমিটারের মধ্যে। মাত্র কয়েক মিনিটের পথ পরোলেই ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করা যায়। আবার এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে চলা পথ ধরে পদ্মা অতিক্রম করলেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা। চাঁপাই থেকে রাজশাহী যেতে সড়ক পথে ২২ পথে নাচোল হয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রবেশ করা যায়। আবার এসব পাকা সড়ক পথে বৃহত্তর রাজশাহীর যে কোন উপজেলায় পৌঁছতে কোন অসুবিধা নেই। এমনকি এই সব পথ ধরে ইচ্ছে করলে বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর পর্যন্ত পৌঁছতে কোন বাধা বিপত্তি নেই। অর্থাৎ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলার বরেন্দ্র ভূমির যে কোন উপজেলা বা ইউনিয়নে যেতে কোন অসুবিধা হবে না এসব পথে। বিশেষ করে গোদাগাড়ী থেকে সরাসরি একটি পথ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল হয়ে রহনপুর পর্যন্ত যাওয়া যায়। আবার এই পথের ডানদিকে অজ¯্র পাকা সড়ক চলে গেছে রাজশাহী থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত। পাশাপাশি নাচোলের বেশ কয়েকটি মহল্লা বা গ্রাম গড়ে উঠেছে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। যে কারণে মুর্শিদাবাদ এলাকার জঙ্গীরা প্রায় সময়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে নাচোল বরেন্দ্রর একাধিক গ্রামে। ইতোমধ্যেই একাধিক অভিযানে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতায় একাধিক ব্যক্তিকে আইন প্রয়োগকারীরা গ্রেফতার করেছে। চিহ্নিত করেছে একাধিক জঙ্গী আস্তানার। এমনকি জঙ্গীদের হাতে জঙ্গী খুন হওয়ার ঘটনাও রয়েছে নাচোল অঞ্চলে। আর তাই পদ্মার আলাতুলি চরে জঙ্গী ডেরার অভিযানের খবরে ভারতের মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলার সীমান্ত জুড়ে হাই রেডএলার্ট দিয়ে বিএসএফ নজরদারি বাড়িয়েছে। এমনকি বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিএসএফ এনে সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। কারণ একটাই মুর্শিদাবাদের বহু স্থানে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় জঙ্গীরা অনায়াসে এপার ওপার হয়ে থাকে। এমনকি আলাতুলি চরের জঙ্গী ডেরার খোঁজ পাওয়ার পর পরই ভারত গঙ্গানদীর প্রায় ২২ চরের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে ভারত। ভারতীয় অঞ্চলের গঙ্গানদীর ২২ চরের একাধিক (চারশত) গ্রামে জঙ্গী আস্তানা গেড়ে উভয় দেশের অভ্যন্তরের অস্থিতিশীল পরিস্থিত সৃষ্টি করার তরতাজা প্রমাণ ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী পেয়েছে বলে জানা গেছে। তারা অনুমান করছে অস্ত্রের একাধিক চালান বাংলাদেশে নয় তাদের গঙ্গা নদীর চরের জঙ্গী ডেরায় একাধিক অস্ত্রের চালান পাঠানো হয়েছে। এই চালানের সঙ্গে প্রায় দুই ডজনের অধিক অস্ত্র ব্যবসায়ী আটক হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রঘুনাথপুর সীমান্তের বিপরীতে মুর্শিদাবাদ জেলা। সমশেরগঞ্জ থানার ধুলিয়ান ডাকবাংলার সামনে থেকে সম্প্রতি একটি গাড়ি থেকে ১৫ নাইম এমএম রিভলবার ও ৪১ রাউন্ড গুলি জব্দ করে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধুলিয়ান অঞ্চল বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি। যদি অস্ত্রের সঙ্গে আটক অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এখন বলার চেষ্টা করেছে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থানার মিঠুপুর অথবা নূরপুর দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বললেও এসব অস্ত্র ও গুলি প্রকৃত পক্ষে তাদের মধ্যকার গঙ্গা নদীর কোন জঙ্গী ডেরায় পাঠানো হচ্ছিল। একটি সূত্র জানায় সমশেরনগর থানার ওসি অমিত ভক্ত স্বীকার করেছে সীমান্ত এলাকা থেকে তারা ৪০ অস্ত্র ও ১৪০ রাউন্ড গুলি জব্দ করে। এসব অভিযানে আটক ব্যক্তিরা ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশ সীমান্তলাগোয়া বৈষ্ণবনগর ও কালিয়াচক থানা এলাকায় তাদের বাড়িঘর। তাদের কাছে একাধিক মোবাইল ও বাংলাদেশী মোবাইল ফোনের নাম্বার ও নাম পাওয়া গেছে। হয় চালান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তলাগোয়া পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর রঘুনাথগঞ্জ এলাকা থেকে জব্দ করে ভারতীয় আইন প্রয়োগকারীরা। এই সময়ে জব্দ হয় ১৫০ কেজি বিস্ফোরক ও ৯ আগ্নেয়াস্ত্র। ১০ জন ধরা পড়ে। অস্ত্রগুলো লালগোলার রামনগর সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছিল। এই সীমান্ত পথে আসা অস্ত্রগুলো আলাতুলি চরের জঙ্গী ডেরায় পাঠানো হচ্ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে এত বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, অস্ত্র ও গুলির প্রকৃত গন্তব্য কোথায় ছিল, তা স্পষ্ট করে বলেনি আটক ব্যক্তিরা। তবে আটককৃতদের দুইজনের মোবাইল ফোনে ৫ বাংলাদেশীর মোবাইল নাম্বার পাওয়া গেছে। তা থেকে এখন অনুমান করা হচ্ছে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছিল। তবে এখন অনুমান করা হচ্ছে বাংলাদেশের চরের জঙ্গী ডেরায় অবস্থানের পর তা ভাগ বাটোয়ারা করা হতো। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গীপুর শহরটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জোহরপুর ও নারায়ণপুর সীমান্তের কাছে অবস্থিত। বেশ কিছু দিন ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এসব সীমান্ত গরু, মহিষ আনার জন্য খুলে রাখা হতো রাতের বেলা। উল্লেখ্য, যে জোহরপুর অঞ্চলে একটি ঘাটাল রয়েছে। রাতের অন্ধকার ও খুলে রাখা সীমান্তকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে বিপুল বিস্ফোরক ও অস্ত্র আনা হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রচুর চর রয়েছে পদ্মার বুকে। ইতোপূর্বেও একই সময় এই পথে ৩৫ কেজি গানপাউডার জব্দের রেকর্ড রয়েছে বিজিবির। তবে এর সঙ্গে ডেটোনেটার বা জেলে এলেও তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে চরের ডেরায় চলে গেছে। গোদাগাড়ীর বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত শহর লালগোলা হচ্ছে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীদের খুবই শক্ত ঘাঁটি। এই গোদাগাড়ী সীমান্ত পথে গত এক বছরে দেড় শত কোটি টাকার হেরোইনসহ ৯ ধরনের মাদক প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ কোটি টাকার মাদক ধরা পড়েছে। এর আগেও গোদাগাড়ী সীমান্তে ভারত থেকে আসা বিপুল বিস্ফোরকসহ তিন জন আটক হয়েছে র‌্যাবের হাতে। পরে নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশ সরকার গোদাগাড়ী আন্তর্জাতিক চেক পোস্টটি বন্ধ করে দেয়। গত এক মাসে সীমান্ত পথে আসা ১৩টি অস্ত্রের চালান জব্দ করে। তার পরেও অস্ত্র, বিস্ফোরক ও জঙ্গীর এপার ওপার হওয়া বন্ধ হয়নি। শেষ মুহূর্তে আষাড়ীয়া দহের কাছাকাছি আলাতুলি চরের জঙ্গী ডেরা ঘেরাও করে বড় ধরনের সফলতা অর্জন করলেও তিন জঙ্গী আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয়ে শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের শেষ পর্যায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ ময়নাতদন্ত শেষে শহরের ফকিরপাড়া গোরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন (২৯/১১/১৭) করে। এর পর পরই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ হাই রেডএলার্ট জারি করে মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলায়। তাদের ধারণা বাংলাদেশের আলাতুলি চরের জঙ্গী ডেরার আদলে ফারাক্কা থেকে বাংলাদেশের ঠুটাপাড়া পর্যন্ত এবং ঠুটাপাড়া থেকে রাজশাহীর পবা পর্যন্ত গঙ্গা রিধৌত যে সব ভারতীয় চর রয়েছে তাতে একাধিক জঙ্গী ডেরা রয়েছে। জঙ্গীরা উভয় দেশের শহর অঞ্চল থেকে তাড়া খেয়ে নির্জন নিরিবিলি গঙ্গার চরে কাঁশবনের মধ্যে অবস্থান নিয়ে নতুন করে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে আদলে গঙ্গার চরের একাধিক জঙ্গী ডেরা চিহ্নিত করার কাজে নেমে পড়েছে। ইতোমধ্যেই তারা কলকাতাসহ নেপাল সংলগ্ন সীমান্ত থেকে একাধিক আল মুজাহিদীন ও আনসারুল্লা বাংলা টিমের জঙ্গীদের ধরার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই তারা একাধিক জঙ্গী নেতাকে আটক করেছে। ভারতে ব্যাপক অভিযানে জঙ্গীরা নেপাল পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পারেনি। তাদের পার্লামেন্টারি নির্বাচনের কারণে সীমান্ত পথে কোন বহিরাগত যাতে নেপালে প্রবেশ করতে না পারে যে দিকে বাড়িয়েছে নজরদারি। যে কারণে জঙ্গীরা নেপাল পালিয়ে যেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতে আটক অধিকাংশ জঙ্গী বাংলাদেশের। একই সঙ্গে উচ্চ শিক্ষিত ও প্রকৌশলী হিসেবে সনদপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার।
×