ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শতকরা ৯৬ ভাগ প্রতিবন্ধী নারী মানসিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

শতকরা ৯৬ ভাগ প্রতিবন্ধী নারী মানসিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ সংবিধান অনুসারে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সমান। কিন্তু দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত সমাজে অবহেলিত হয়ে থাকেন প্রতিবন্ধীরা। দেশের শতকরা ৯৬ ভাগ প্রতিবন্ধী নারী মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। শতকরা ১ ভাগের কমসংখ্যক প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশু স্কুলে যায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়নেও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ এখনও নেয়া হয়নি। আইন ও নীতিমালায় সামাজিক বৈষম্য, নিপীড়ন রোধ এবং প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও তার বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ প্রকাশ করেছে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা দেশের বিভিন্ন সংস্থা। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে, শিক্ষাগ্রহণ, সরকারী ও বেসরকারী সকল চাকরিতে, পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে, অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতাপ্রাপ্তিতে, সড়ক-মহাসড়কের ফুটপাথে হাঁটতে কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের প্রায় ১৫ লাখ প্রতিবন্ধীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। শারীরিক, মানসিক কিংবা শ্রবণপ্রতিবন্ধী কেউই বাদ পড়ছে না এ অবহেলার কবল থেকে। বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন নতুন আইন প্রণয়ন ও উদ্যোগ হাতে নিলেও যথাযথ প্রচারের অভাব ও সকল শ্রেণীর নাগরিকের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি না হওয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উইমেন উইথ ডিজএ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডাব্লিউডিডিএফ) চেয়ারপার্সন শিরিন আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘৩ ডিসেম্বের দেশব্যাপী পালিত হলো ১৯তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য টেকসই ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ি’। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই শুধু নয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। দেশের বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থান, দেশীয় আইন ও নীতি, আন্তর্জাতিক সনদ ও অঙ্গীকার, সমাজের মূল ধারায় সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ এবং সার্বজনীন মানবাধিকার চর্চা এবং রাষ্ট্রীয় সেবাসমূহ প্রাপ্তিতে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমরা সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে আছি। নাগরিক সুবিধা থেকে এখনও আমরা বঞ্চিত। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা হিসেবে প্রতি মাসে সাত শ’ টাকা করে পান। এ অর্থ দিয়ে সে কিভাবে পড়ালেখা করবে, কিভাবে অন্ন যোগাবে অথবা তার চিকিৎসা করাবে ?’ ‘প্রতিবন্ধী নারীর সার্বজনীন অবস্থা’র ওপর পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর ৭৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। বিদ্যালয়ে যারা গেছেন তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। ৪৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী স্বাস্থ্যসেবা পান না। ৭৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাননি। ৬৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী নিজ পরিবারে শারীরিক, মানসিক ও বহুমুখী নির্যাতনের শিকার হন। ৮৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী আইনী সহয়তা পান না, বাকি ১৬ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ সাধারণ বিচার প্রার্থীর মতো সুযোগ পান। এছাড়া, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনী অধিকার থাকা সত্ত্বেও তারা বঞ্চিত। শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিভিন্ন প্রকার আইনে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বিশেষতঃ বাক, শ্রবণ, বাক ও শ্রবণ বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া কেমন হবে? বা বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের স্বাক্ষ্য গ্রহণকালে ভাষাগত যোগাযোগ ও ভাব বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ইশারা ভাষার ব্যবহার করতে হবে সেই নির্দেশনা না থাকার কারণে বাক, শ্রবণ বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীরা সুবিচার পান না। তাছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের স^াক্ষ্য অনেক সময় আদালত গ্রহণ করে না। এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণের অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়ার কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীরা আদালতে যেতে পারে না। প্রতিবন্ধী নারীরা প্রথম বাধার শিকার হন পুলিশ স্টেশন ও মেডিক্যাল রিপোর্ট পেতে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জেন্ডার এ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিন এ বিষয়ে বলেন, ‘বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীদের ভাষা বোঝার জন্য বিচার চলাকালীন ইশারা ভাষার ব্যবহার, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্কে কোন আইনী নির্দেশনা নেই। সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণের পদ্ধতিগত ব্যাখ্যা কোন আইনে নাই। নির্যাতিতা প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষা ও বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ কোন আইনেই নির্দেশনা নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসচেতনতার কারণেও সুবিচার প্রাপ্তির অধিকার থেকে প্রতিবন্ধীরা বঞ্চিত হয়।’ বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এককভাবে রাস্তায় চলাচলের কোন সুন্দর পরিবেশ নেই। সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়ক, ফুটপাথ, ফুট ওভারব্রিজসহ গণপরিবহন প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তেমন সাড়া মেলেনি। নির্দেশানুযায়ী প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ থাকার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের জন্য ছোট পাবলিক বাসে কমপক্ষে ৬টি ও বড় বাসের ক্ষেত্রে ৯টি আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি নিয়ে তেমন জনসচেতনতা না থাকায় এখনও এসব আসনে প্রতিবন্ধীরা বসতে পারেন না। বাস বা যে কোন গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের ওঠার সুযোগ থাকলেও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোন গণপরিবহনেই ওঠার সুযোগ নেই। বিশেষ করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বেলায় তা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া লাইন ধরে বাসে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীদের কোন প্রকার অগ্রাধিকার পর্যন্ত দিতে দেখা যায় না। মূলত স্থাপনা ও ভবন অথবা ফুটপাথের পাশে ঢালু পথ বা র‌্যাম্প, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ব্রেইল ব্লক, লিফটে ফ্লোর এ্যানাউন্সমেন্ট, ব্রেইল বাটন, স্বল্প দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কিছু ছবির ব্যবহার বা ভবনের ম্যাপ তৈরি, কিছু বিশেষ রঙের ব্যবহার এসব প্রতিবন্ধী মানুষের চলার পথকে আরও সহজ করতে পারে। এসব পদ্ধতির কোন ব্যবহার না থাকায় প্রতিবন্ধীরা চলাচলে ও সমাজে বসবাসের ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়েন। মানবাধিকারকর্মী এ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘বাংলাদেশের সড়ক, রেল, গণপরিবহন এবং গণস্থাপনায় প্রবেশগম্যতার অভাবে প্রতিবন্ধী নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবং নারীত্ব ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সমাজের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ফলে দেখা যায়, শতকরা ৯৯ ভাগ প্রতিবন্ধী নারী দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসচেতনতার কারণেও সমধিকার প্রাপ্তির অধিকার থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়। প্রতিবন্ধিতার সঙ্গে অর্থনৈতিক সক্ষমতার একটি সম্পর্ক আছে। যা ন্যায় ও সুবিচার প্রাপ্তির পদক্ষেপ গ্রহণের বড় বাধা।’ বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা কত সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পৃথক দুটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১০ থেকে ১৬ ভাগ পর্যন্ত বলা হয়েছে। এ তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তবে সমাজকল্যাণ সংস্থা পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচী অনুযায়ী দেশে এ মুহূর্তে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৭১৬ জন। তবে অন্যান্য সংস্থার দাবি, দেশে প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। অনেক পিতামাতাই সমাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তার সন্তানকে প্রতিবন্ধী হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত করতে রাজি হন না। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানের বেলায় তা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ১৫.৭ শতাংশ।
×