ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসির সিয়াম

গল্প ॥ জন্মদিনের উপহার

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

গল্প ॥ জন্মদিনের উপহার

মাত্র কয়েকদিন হলো মুনার জেএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এই কয়েক দিনেই শহরের বন্ধ ঘরে সে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই মুনা বাবার কাছে ভীষণ বায়না ধরল, দাদু বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই যে পিইসি পরীক্ষার পর মুনা দাদু বাড়িতে গিয়েছিল, এরপর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আর কিছুদিন পরই মুনার জন্মদিন। সে চায় এবারের জন্মদিনটা তার দাদু দিদার সঙ্গেই পালন করা হোক। মেয়ের কোন কথাই ফেলতে পারে না মাজহার সাহেব। এবারও মেয়ের আবদারে রাজি না হয়ে পারলেন না তিনি। কিন্তু বছরের শেষ দিকে অফিস থেকে বেশি ছুটি পাওয়া যাবে না। তাই তিনি ঠিক করলেন আগে মুনা আর তার মাকে পাঠিয়ে দিয়ে পরে তিনি মুনার জন্মদিনের সময় কেক আর উপহার নিয়ে যাবেন। শীতের সময় এর আগে কখনও মুনার গ্রামের বাড়িতে আসা হয়নি। শিশির ভেজা সকালের অপরূপ প্রকৃতি এবারই মুনা গ্রামের বাড়িতে এসে প্রথম দেখল। মুনাকে তার দাদু দিদা, চাচা-চাচিরা খুব ভালবাসেন। অনেকদিন পর গ্রামের বাড়িতে আসায় বাড়ির সকলেই মুনাকে ঘিরে উৎসবের আমেজে মেতে উঠেছে। গতকাল জার্নি করে সে খুব ক্লান্ত। তাই সে ভেবেছিল আজ একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠবে। কিন্তু ভোর হতে না হতেই মা এসে মুনাকে ডাকতে শুরু করল। মায়ের ডাকে বিছানায় উঠে বসল মুনা। আহ্লাদের স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে মা? এখন তো আমার স্কুলও নেই যে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে! মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন মিসেস রেহানা। সত্যিই তো, পড়ালেখার চাপে আজকাল মেয়েটা ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না। সারাদিন স্কুল, আর প্রাইভেটে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে তার খাওয়াটাও সময়মতো হয়ে ওঠে না। মেয়ের মাথায় হাত রেখে উত্তর দিলেন তিনি, তুমিই না গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতে চেয়েছিলে! শীতের সময় এই ভোরবেলাতেই আসল গ্রামের দৃশ্য লুকিয়ে থাকে। সেটা না দেখে ঘুমাবে? তাছাড়া বাইরে গিয়ে দেখ, উঠানে তোমার দিদা তোমার জন্য কত মজার মজার পিঠা বানাচ্ছেন। মায়ের কথা শুনে বিছানা থেকে নেমে হাতমুখ ধুয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালো মুনা। সত্যিই তো, দিদার চারপাশ ঘিরে চাচিরা বসে পিঠা বানাতে দিদাকে সাহায্য করছেন। এমনকি পাশের বাড়ি থেকেও অনেক মহিলারা এসেছেন। দেখে মুনার ভারি আনন্দ লাগল। এ যেন একটা পিঠা উৎসব চলছে। এত হৈ হুল্লোড়, হাসি মজা তো তাদের স্কুলের পিঠা উৎসবেও হয় না। মুনাকে উঠানে আসতে দেখে দিদা মুনাকে তার কাছে ডেকে নিয়ে বসালেন। এরপর একটা ভাপা পিঠা হাতে দিয়ে বললেন, কেমন হয়েছে খেয়ে দেখত দিদিভাই। তুমি এখনও খাওনি বলে কাউকে পিঠা দেইনি। পিঠা মুখে দিয়ে মুনা তৃপ্তি করে খাচ্ছে।। পিঠা খেতে খেতেই সে লক্ষ্য করল, ছোট চাচা একটা মাটির হাঁড়ি হাতে নিয়ে আসছেন। মুনাকে দেখতে পেয়ে ছোট চাচা হাঁড়িটা দেখাতে দেখাতে বললেন, তোমার জন্য খেজুরের রস নিয়ে আসলাম, মামণি। পিঠা খাওয়ার পর খেজুরের রস খাবে। দেখবে টাটকা খেজুরের রস খেতে খুব মজা লাগবে। মুনা কখনও খেজুরের রস খায়নি। তাই ছোট চাচার কথা শুনে তার আনন্দ যেন আর ধরছে না। সবাই তাকে কত ভালবাসে, অথচ এই মানুষগুলোর থেকেই সে কত দূরে থাকে! ধীরে ধীরে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে মুনার বয়সীই অনেক ছেলেমেয়ে এসে জমা হলো উঠানে। গ্রামে নাকি এক বাড়িতে পিঠা বানানো হলে সবাই মিলে এভাবেই একসঙ্গে হয়ে পিঠা খায়। কিন্তু একটা জিনিস দেখে একটু অবাক হলো মুনা। এই শীতের ভোরে এত ভারি একটা সোয়েটার পরেও তার শীত কাটতে চাইছে না, অথচ কিছু ছেলেমেয়ে এসেছে যাদের শরীরে কোন শীতের পোশাকই নেই। মাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে জানতে চাইল মুনা, আচ্ছা মা, ওদের কি শীত করে না? মুনার মা ধীর গলায় জবাব দিলেন, শীত তো সবারই করে। ওদের হয়ত শীতের পোশাক নেই। গ্রামে যখন এসেছ, তখন গ্রামের মানুষরা কত কষ্ট করে সেটা দেখতে পারবে। তারই বয়সী ছেলেমেয়েগুলো শীতে কত কষ্ট করছে! মায়ের কথাগুলো শুনেই মুনার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে আর পিঠা না খেয়ে ঘরে চলে গেল।! অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে মুনা একটা বুদ্ধি বের করল। মার মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাবার কাছে ফোন করল সে। -হ্যালো বাবা, কবে আসছো তুমি? ওপাশ থেকে মাজহার সাহেব উত্তর দিলেন, এই তো মা তোমার জন্মদিনের তো আর মাত্র দুদিন বাকি। আমি পরশুই তোমার জন্য কেক, নতুন জামা আর উপহার নিয়ে রওনা হব। মুনা একটু চুপ করে থেকে এরপর জবাব দিল, এবারের জন্মদিনে এসব চাই না আমার, বাবা। এবারের জন্মদিনের জন্য আমি অন্য একটা কথা ভেবেছি। আমাদের গ্রামে আমার মতো অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা এই শীতের মাঝেও শীতের পোশাক না থাকায় কষ্ট করে থাকে। আমি চাই, আমার জন্মদিনের কেক, জামা আর উপহারের টাকা দিয়ে তুমি ওদের জন্য শীতের পোশাক কিনে নিয়ে আসবে। মেয়ের কথায় খুব খুশি হলেন মাজহার সাহেব। বাহ, মেয়েটা যে এত লক্ষ্মী হয়েছে তিনি জানতেনই না! বললেন, তুমি যেটা বলবে সেটাই হবে মামণি। তাহলে আমি ওদের জন্য শীতের পোশাক কিনে নিয়ে তোমার জন্মদিনের দিন আসব। -থ্যাংক ইউ, বাবা। আমি নিজের হাতে সবাইকে শীতের পোশাকগুলো উপহার দিতে চাই। দেখবে ওরা খুব খুশি হবে। আর এটাই হবে আমার এবারের জন্মদিনের উপহার। দেখতে দেখতে মুনার জন্মদিন চলে আসল। মাজহার সাহেব সকালের দিকে বাড়িতে এসে পৌঁছালেন। তার হাতভর্তি শীতের জামা-কাপড়ের বড় ব্যাগ দেখে সবাই বেশ অবাক হলেন। পরে তিনি আস্তে আস্তে সবাইকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। মুনার কথা চিন্তা করে দাদু-দিদা, চাচা-চাচিরা খুব গর্ব করতে লাগলেন। সেদিন বাড়িতে আসা সবগুলো ছেলেমেয়েকে ডেকে নিয়ে আসা হলো। এরপর মুনা এক এক করে সবার হাতে তুলে দিল শীতের পোশাকগুলো। শীতের সকালে শীতের নতুন পোশাক পেয়ে সবার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। আর এ খুশি দেখেই মুনা তার বাবাকে দেখিয়ে বলল, দেখেছ বাবা ওরা কত খুশি হয়েছে! এই তো তোমার নিয়ে আসা আমার জন্মদিনের উপহারগুলো আমি পেয়ে গেলাম। ১ম বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×